মরণোত্তর অঙ্গদানে এগোচ্ছে পশ্চিমবঙ্গ
১৯ জানুয়ারি ২০১৯বেহালা ম্যান্টনের শর্মিষ্ঠা দাস চাকরি করেন৷ হঠাৎ দেখা দিলো কিডনির সমস্যা৷ ডায়ালাইসিস করতে করতে প্রচুর অর্থ খরচ হচ্ছে৷ অন্যের কিডনি নিয়ে প্রতিস্থাপন করানোর অত সামর্থ্য কোথায়? কিডনি কেনাবেচার জগৎ সম্পর্কে তাঁদের জানাও নেই৷ অতএব দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে সপ্তাহে দুটো করে ডায়ালাইসিসই ছিলো ৩৮ বছর বয়সি এর শর্মিষ্ঠার ভবিতব্য৷
মুর্শিদাবাদের বাসিন্দা ৪৮ বছরের হাবিবুর রহমানেরও একই অবস্থা৷ তাঁর হৃদপিণ্ড না প্রতিস্থাপন করালেই নয়, এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিলো৷ এত টাকা কোথা থেকে মিলবে, চিন্তা ছিল সেটাই৷
‘ব্রেন ডেথ' রোগীর কিডনি, হার্ট, লিভার-সহ বিভিন্ন অঙ্গ একজন অসুস্থ মানুষের শরীরে প্রতিস্থাপিত করে রোগীকে নতুন জীবন দেওয়া সম্ভব৷ এই মরণোত্তর অঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ যে ক্রমশ এগিয়ে চলছে, তার প্রমাণ শর্মিষ্ঠা ও হাবিবুর৷ ডয়চে ভেলেকে শর্মিষ্ঠা বললেন, ‘‘আড়াই বছর ডায়ালাইসিস করার পর আজ ট্রান্সপ্ল্যান্ট হয়েছে৷ আমার সেই সামর্থ্য ছিল না৷ আজ ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্লান্টের জন্যই আমি ভালো হতে পেরেছি৷'' একই বক্তব্য হাবিবুরের পরিবারের৷
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল মিলিয়ে ২০১৭ সালের তুলনায় ২০১৮-তে রাজ্যে মরণোত্তর অঙ্গদানের হার বেড়েছে৷ ২০১৮-তে ৩৮টি ক্যাডাভেরিক ট্রান্সপ্ল্যান্ট বা মরণোত্তর অঙ্গ প্রতিস্থাপন হয়েছে৷ গত বছরের শেষে ২০ বছরের সজল কর গাড়ি দুর্ঘটনায় মস্তিষ্কে গুরুতর চোট পান৷ ছেলে আর ফিরে আসবে না জেনেই দক্ষিণ কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে তাঁর পরিবার অঙ্গদানের সিদ্ধান্ত নেয়৷ ব্রেন ডেথ হওয়া সজলের হার্ট পান কলকাতা মেডিকেল কলেজের রোগী হাবিবুর৷ একটি কিডনি পান বেহালার শর্মিষ্ঠা৷ এভাবেই সজলের অঙ্গপ্রত্যঙ্গে নবজীবন লাভ করেছেন আরও একাধিক রোগী৷
সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৬টা সফল হৃদপিণ্ড প্রতিস্থাপন করে পশ্চিমবঙ্গ এই বিষয়ে নয়া দিগন্তের সূচনা করেছে৷ ডয়চে ভেলেকে মেডিকেল কলেজের কার্ডিওথোরাসিক বিভাগের প্রধান এবং প্রতিস্থাপন বিশেষজ্ঞ ডাঃ প্লাবন মুখোপাধ্যায় বললেন, ‘‘প্রথম প্রতিস্থাপন হয়েছিল রাখাল দাসের৷ তারপর হাবিবুরের৷ সবাই ভালো আছেন৷ এছাড়া যাদের হয়েছে, তারাও ভালো আছে৷'' ২০১৯ সালে অঙ্গ প্রতিস্থাপনের কাজ আরও বাড়বে আশা করা হচ্ছে৷ মরণোত্তর অঙ্গ দেওয়ার ব্যাপারে এখন সবাই অনেক বেশি সচেতন৷
মেডিকেল কলেজের সুপার এবং ভাইস প্রিন্সিপাল ইন্দ্রনীল বিশ্বাস বলেন, ‘‘গণমাধ্যম অঙ্গদানের ব্যাপারে সচেতনতা যথেষ্ট বাড়িয়েছে৷ ব্রেন ডেথ রোগীর পরিবার এখন অনেক সচেতন৷ আমরা কোনও পরিবারকে অঙ্গদানের জন্য জোর করতে পারি না, কেবল বলতেই পারি৷ তাই সচেতনতা বাড়ানো জরুরি৷''
মেডিকেল কলেজের চিকিৎসক ডাঃ উষ্ণীষ চক্রবর্তী বলেন, ‘‘ডাক্তাররা যখন রোগীদের ওষুধ দিয়েও সামাল দিতে পারেন না, তখন তাঁরা প্রতিস্থাপনের জন্য পাঠান৷ অঙ্গ অচল এমন রোগীদের একটা রেজিস্টার আছে৷ ব্রেন ডেথ রোগী পাওয়া গেলে জরুরি ভিত্তিতে রোগীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়৷''
চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, অঙ্গ প্রতিস্থাপনে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থা রোটো-র কিছু নির্দেশিকা আছে, সেগুলি মানতে হয় হাসপাতালকে৷ যে হাসপাতালে রোগীর ব্রেন ডেথ হয়, সেখানে কারো অঙ্গ প্রতিস্থাপন দরকার হলে তিনিই অগ্রাধিকার পাবেন৷ কোনো রোগী না থাকলে রাজ্যের অন্য সরকারি হাসপাতালে দেখা হবে৷ তারপরে দেখা হবে বেসরকারি হাসপাতালে৷
এই নিয়মেই দক্ষিণ কলকাতার যে বেসরকারি হাসপাতালে শর্মিষ্ঠার ডায়ালাইসিস চলছিল, সেখানেই ব্রেন ডেথ রোগী পাওয়া যায়৷ ফলে কিডনির ক্ষেত্রে শর্মিষ্ঠা অগ্রাধিকার পান৷ এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপ্লান্ট বিশেষজ্ঞ ও নেফ্রোলজিস্ট ডাঃ সন্দীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘শর্মিষ্ঠার শারীরিক অবস্থা বিবেচনা করে রোটোতে আমি আগেই ওর কথা বলে রেখেছিলাম৷''
অঙ্গদান সংক্রান্ত পরিকাঠামো উন্নত হচ্ছে৷ এমনকি অ্যাম্বুলেন্সে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে অঙ্গ স্থানান্তরের জন্য সড়কে রয়েছে বিশেষ লেন, যার নাম গ্রিন করিডোর৷ তবে এখনও উন্নতির অনেক অবকাশ রয়েছে৷ মরণোত্তর প্রতিস্থাপনের সংখ্যা বাড়লে ক্রমশ কমবে অঙ্গ পাচার চক্রের দৌরাত্ম্য৷ বহুদিন ধরেই পশ্চিমবঙ্গ সহ গোটা দেশে অঙ্গ কেনাবেচার চক্র সক্রিয়৷ বিপুল টাকা অবৈধভাবে লেনদেন হয়৷ শর্মিষ্ঠা ও তার স্বামী শান্তনু দাস জানিয়েছেন, ‘‘কিডনির জন্য তাঁদের কাছে ৭ লক্ষ টাকাও চাওয়া হয়েছিল৷''
২০১৮-র থেকে এই বছরে মরণোত্তর প্রতিস্থাপনে বেশি সাড়া মিলবে বলে আশা চিকিৎসকদের৷ ডাঃ সন্দীপ ভট্টাচার্যের মন্তব্য, ‘‘আপাতত রাজ্যের রোগীদের চাহিদা মেটানোই লক্ষ্য৷ পরে অন্য রাজ্যেও আমরা অঙ্গ দান করতে পারব৷ এজন্য মরণোত্তর অঙ্গদানের সংখ্যা আরো বাড়াতে হবে৷ মনে রাখতে হবে, পরলোকে অঙ্গের প্রয়োজন নেই৷ প্রয়োজন আছে আমাদের পৃথিবীতে৷''
প্রতিবেদনটি কেমন লাগলো জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷