আইসিইউ বেডের সংকট কেন?
২৪ মার্চ ২০২১বিভিন্ন হাসপাতালে কথা বলে জানা গেছে, আগে প্রতি ১০ জন করোনা আক্রান্তের মধ্যে সর্বোচ্চ একজনের আইসিইউ প্রয়োজন হত৷ এখন প্রয়োজন হয় তিন জনের৷ আর সংক্রমিত বড় একটি অংশের অক্সিজেনের মাত্রা শুরুতেই ৭০-৮০ ভাগে নেমে যাচ্ছে৷ স্বাভাকিভাবে এটা ৯৭ ভাগের উপরে থাকে৷
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সহকারী রেজিষ্ট্রার ডা. মোক্তাদির ভুঁইয়া বলেন, ‘‘এবার সিরিয়াস রোগীর সংখ্যা বেশি৷ আর রোগীও প্রতিদিনই বাড়ছে৷ আইসিইউ সাপোর্ট আগের চেয়ে বেশি লাগছে৷ কিন্তু আইসিইউ বেড তো বাড়েনি৷’’
পরিস্থিতি কী?
মো. শফিউল্লাহ একজন সরকারি কর্মকর্তা৷ তার মা করোনায় আক্রান্ত৷ তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়ায় শনিবার কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি করা হয়৷ প্রথম দিনই তার আইসিইউ সাপোর্ট প্রয়োজন হলেও একদিন পর তাকে আইসিইউ বেড দেয়া হয়৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি এবং আমাদের পরিবারের যারা আছেন তারা সবাই মিলে সব চ্যানেল ব্যবহার করে মায়ের জন্য আইসিইউর ব্যস্থা করেছি৷ কিন্তু অনেকেই তা পারছেন না৷ পারবেন কীভাবে এই হাসপাতালে আইসিইউ বেড মাত্র ১০টি৷’’ তিনি জানান কোনো আইসিইউ বেডই এখন আর ফাঁকা নেই৷ অনেক রোগীই প্রয়োজন হলেও আইসিইউ বেড পচ্ছেন না৷ চিকিৎসকেরাও অসহায়৷
নুরুজ্জামান লাবু একজন সাংবাদিক৷ তিনি বুধবার সকালে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছেন করোনা রোগীর জন্য ঘরে ব্যবহার করার অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ জানতে৷ তিনি জানান, তার ভাগ্নে করোনা আক্রান্ত, তীব্র শ্বাসকষ্ট হচ্ছে বলে অক্সিজেন সিলিন্ডারের খোঁজ করছেন৷ হাসপাতালে না নিয়ে অক্সিজেন সিলিন্ডার কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘হাসপাতালগুলোতে এখন রোগীদের ভিড়৷ আর সরকারি হাসপাতালে আইসিইউ বেড খালি নাই৷ আমাদের বাসার পাশে একটি প্রাইভেট হাসপাতালে যোগাযোগ করেছিলাম৷ তাদের করোনার জন্য দুই ধরনের বেড আছে৷ রেড এবং ইয়োলো৷ তাদের আইসিইউ আছে৷ ভর্তিতে তারা রেডের জন্য এক লাখ এবং ইয়োলোর জন্য ৫০ হাজার টাকা আগাম চায়৷ আর্থিক দিক বিবেবচনা করে তাই বাসায় অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে এসেছি৷ দেখি কী হয়৷’’
করোনায় আইসিইউ বেড চিত্র:
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসেবে সারাদেশে এখন করোনা রোগীর জন্য আইসিইউ বেডের সংখ্যা ৫৪৯টি৷ আর আইসিইউ বেডে ভর্তি করোনা রোগীর সংখ্যা ৩২৩ জন৷ খালি আছে ২২৬টি বেড৷ স্বাস্থ্য অধিপ্তরের ২৪ মার্চের আগের ২৪ ঘন্টার হিসাব এটি৷ এই সাধারণ হিসাব দেখে করোনা রোগীদের আইউসিইউ বেডের সংকট চলছে তা বোঝা মুশকিল৷
ঢাকা শহরের চিত্রটি তুলে ধরলে বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে৷ ঢাকার সরকারি হাসপাতালগুলোতে আইসিইউ বেডের সংখ্যা ১০৩টি৷ তার মধ্যে খালি আছে মাত্র সাতটি৷ ২৪ ঘন্টা আগের এই হিসাব৷ ২৪ ঘন্টা পরে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটেছে৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল ও বিএসএমইউ হাসপাতালে করোনা রেগীর জন্য কোনো আইসিইউ বেড খালি নাই৷
ঢাকার বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে করোনা রোগীদের জন্য আইসিইউ বেড ২৬৭টি৷ খালি আছে ৪৫টি৷
ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামে করোনার জন্য আইসিইউ বেড আছে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে ৪৫টি৷ খালি আছে ২৩টি৷
ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাইরে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে করোনার জন্য আইসিইউ বেড আছে ২৩৭টি৷ খালি আছে ১৫৮টি৷ তুলামূলকভাবে বেড খালি থাকার হিসেবে ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রাম মহানগরী এবং চট্টগ্রামের চেয়ে দেশের বাকি এলাকার অবস্থা ভালো৷
ঢাকায় কোভিড হাসপাতাল হিসেবে পরিচিত হাসাপতালগুলোতে করোনার জন্য আইসিইউ খালি নেই৷ যে সাতটি বেড খালি আছে সেগুলো বিশেষায়িত হাসপাতাল৷ ভিআইপিদের৷ বেসরকারি হাসপাতালে থাকলেও তা সাধারণের নাগালের বাইরে৷
এদিকে জানুয়ারির পর ধীরে ধীরে আইসিইউ বেডের সংখ্যা কমানো হয়েছে৷ জানুয়ারিতে সারাদেশে করোনার জন্য আইসিইউ বেডের সংখ্যা ছিলো ৬৮৮টি৷ আর এখন তা কমে দাঁড়িয়েছে ৫৪৯টি৷ কিন্তু এখন আইসিইউর চাহিদা বেশি৷
কেন এই পরিস্থিতি?
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সর্বশেষ হিসেবে গত ২৪ ঘন্টায় বাংলাদেশে আরো নতুন করে তিন হাজার ৫৬৭ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন৷ মারা গেছেন ২৫ জন৷ এপর্যন্ত মারা গেছেন আট হাজার ৭৬৩ জন৷ আর এপর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ লাখ ৮০ হাজার ৮০৮ জন৷ গত ২৪ ঘন্টায় সংক্রমণের হার শতকরা প্রায় ১৩ ভাগ (১২.৯৭), যা উদ্বেগজনক বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা৷ গত বছরের ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করেনা রোগী সনাক্ত হয়৷
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী বলেন, এবার করোনা সংক্রমণের তীব্রতা আগের চেয়ে বেশি৷ অধিকাংশ রোগীর অক্সিজেন লাগছে৷ আর আগে প্রতি ১০ জনে একজনের আইসিইউ লাগত, এখন লাগছে তিন জনের৷ তিনি বলেন, ‘‘ইউকে ভেরিয়েন্ট এবং আফ্রিকান স্ট্রেইনের জন্য এই পরিস্থিতি হতে পারে৷’’ আর এবার বয়স্কদের সাথে তরুণেরাও আক্রান্ত হচ্ছে বলে জানান চিকিৎসকরা৷ তিনি বলেন, ‘‘কেউ কেউ মনে করেছেন করোনা আর আসবে না তাই কোভিড আইসিইউর সংখ্যাও কমিয়ে ফেলা হয়েছে৷ আর করোনাকে আমরা সবাই মিলে অবহেলা করেছি৷ টিকা দেয়ার ক্ষেত্রেও পরিকল্পনা যথাযথ হয়নি৷’’
ডা. মোক্তাদির ভুঁইয়া বলেন, ‘‘করোনার জন্য চাইলেই আইসিইউ বেড রাতারাতি বাড়ানো সম্ভব নয়৷ কিছু বেড কমানোও হয়েছে৷ সাধারণ বেডে রূপান্তর করা হয়েছে৷ তবে সরকার চাইলে বাড়ানো সম্ভব৷’’ গত বছর করোনার সময় আইসিইউ বেড বাড়ানোর কথা বলা হলেও বাস্তবে তা বাড়েনি৷
ঢাকা মেডিকেলের পরিচালক কর্নেল মো. নাজমুল হক জানান, ‘‘করোনা রোগী প্রতিদিনই বাড়ছে৷ হাই ফ্লো জোন এবং হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা দিয়ে আমরা রোগীদের সুস্থ করার চেষ্টা করছি৷ তারপরও সম্ভব না হলে আমরা রোগী আইসিইউতে পাঠাই৷ চেষ্টা করছি আইসিইউর ওপর চাপ কমাতে৷’’
তিনি বলেন, শুরু থেকেই ঢাকা মেডিকেলে গুরুতর করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে৷ তাই এখন যা পরিস্থিতি তা তারা সামলাতে পারছেন আগের অভিজ্ঞতার কারণে৷