‘আফগানিস্তানের ব্যাপারে যে যা বলবে মেনে নিতে হবে, সেরকম নয়'
২০ আগস্ট ২০২১ডয়চে ভেলে : আফগানিস্তানের এই পরিবর্তনে বাংলাদেশে তাৎক্ষনিক কোন প্রভাব পরতে পারে?
অধ্যাপক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ : আফগানিস্তানে তালেবান ক্ষমতায় আসার বিষয়টির বাংলাদেশে কোনো প্রভাব পড়ার কথা না৷ কারণ হচ্ছে, এর মধ্যে দু'টি দেশ আছে ভারত ও পাকিস্তান৷ এই দুই দেশের সঙ্গে আফগানিস্তানের অনেক ধরনের সম্পর্ক আছে৷ আমরা গত ২০ বছর আফগানিস্তানের সঙ্গে এমন কোনো সম্পর্ক করিনি৷ আমাদের কোনো মানুষও ওখানে নেই, যেটা মধ্যপ্রাচ্যে আছে৷ ফলে ওখানে একটা পরিবর্তন এসেছে বলে এখানে কিছু হবে এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই৷
আঞ্চলিক ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কোনো অস্থিরতা তৈরি হতে পারে?
সেটার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে৷ ২০ বছর আগের তালেবানের সঙ্গে এখনকার তালেবানের কথার পার্থক্য আছে৷ এখন দেখতে হবে কে প্রধানমন্ত্রী হচ্ছে, কে রাষ্ট্রপতি হচ্ছে, কে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হচ্ছে৷ মূল কথা হলো, সরকারের রূপরেখা যখন পরিস্কার হবে তখন হয়ত আরেকটু বোঝা যাবে৷ ভূ-রাজনৈতিক কোনো প্রভাব ফেলবে কিনা সেটা এখনই বললে একটু আগেভাগে বলা হয়ে যাবে৷ বিভিন্ন ফোর্স বিভিন্নভাবে চেষ্টা করতে পারে৷ তবে তালেবানের যারা ক্ষমতায় এলো এখন তারা দেখাতে পারবে কিনা একটা স্থায়ী সরকার গঠন করতে পেরেছে৷ গত দুই তিন-দিনে তারা যেসব কথাবার্তা বলেছে সেটা তারা রক্ষা করতে পারলো কিনা৷ আন্তর্জাতিক কমিউনিটি তাদের কিভাবে নিচ্ছে৷ এগুলো না হওয়া পর্যন্ত বলা মুশকিল৷
সারাবিশ্বের জঙ্গিরা তালেবানের এই জয়কে নিজেদের জয় হিসেবে দেখছে? বাংলাদেশের জঙ্গিরা এ থেকে কি উদ্বুর্দ্ধ হতে পারে?
না৷ যে কোনো জঙ্গিবাদ যখন মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে তখন রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রীয় কোনো গোষ্ঠীর পৃষ্ঠপোষকতা থাকে৷ ছোটখাটো কিছু করতে পারে, কিন্তু বড় আকারে সেটা সম্ভব না৷ ২০ বছর আগের আর ২০ বছর পরের বাংলাদেশের মধ্যে পার্থক্য আছে৷ এখন যারা বাংলাদেশে ক্ষমতায় আছে, তারা তো হোলি আর্টিজানের ঘটনার পর জিরো টলারেন্সে গেছে৷ জঙ্গিবাদ থামানোর জন্য একাধিক স্ট্রাকচার তৈরি করেছে৷ এক জন-দুই জন বিচ্ছিন্নভাবে আগ্রহ দেখাতে পারে, কিন্তু বিস্তারের জন্য রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার৷ এখানে সেটা তো নেই৷
সারাবিশ্বে কি কট্টরপন্থা মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে?
এই মহামারিতে তো এক ধরনের কট্টরপন্থা আমরা দেখছি৷ অ্যামেরিকাতে তো ট্রাম্পের সময় একটা কট্টরপন্থা ছিল৷ ইউকে যদি ধরি, জনসন আরেক কট্টরপন্থি৷ ব্রাজিলে আরেক কট্টরপন্থী৷ আমাদের পাশের দেশ ভারত একটা কট্টরপন্থি৷ অষ্ট্রেলিয়ায় কট্টপন্থি, মিয়ানমারেও বুদ্ধিষ্ট কট্টরপন্থার আধিপত্য আছে৷ ফলে এক ধরনের কট্টপন্থিরা তো ক্ষমতায় আছে৷ আরেকটা ইসলামের নামে কট্টরপন্থা যোগ হলে সেটা অস্বাভাবিক না৷ আমরা যদি ইরান বা তুরস্কের দিকে তাকাই, তাহলে দেখবো তারা অনেক পরিপক্ক হয়ে গেছে৷ ইরানের নেগোসিয়েশনের ক্যাপাসিটি কিন্তু অনেক৷ এর মধ্যেও দেখেন তারা একটা ভ্যাকসিন তৈরি করতে পেরেছে৷ মিডিয়া একটা দেশের ব্যাপারে যেভাবে প্রচার করে, পরে দেখা যায় সেটা আসলে ওভাবে হয় না৷ এখন কট্টরপন্থিদের একটা আমল যাচ্ছে এতে কোনো সন্দেহ নেই৷
আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তো বলেছেন, সেখানে স্থায়ী সরকার হলে বাংলাদেশ সহযোগিতা করবে৷ তাদের সঙ্গে তো আমাদের কূটনৈতিক কোনো সম্পর্কই নেই৷ সরকার যদি চায় তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক করতে, তাহলে সেটা কীভাবে হতে পারে? কোনো বাধা আছে?
প্রথমত, আমাদের অত কাজের তাড়া নেই৷ আমাদের সঙ্গে তাদের বড় কোনো সম্পর্ক নেই৷ আমাদের কোনো বিশাল জনগোষ্ঠী সেখানে নেই, যেটা ভারত বা পাকিস্তানের আছে৷ সে কারণে আমরা খুব ধীর গতিতে এই সিদ্ধান্ত নিতে পারবো৷ আমাদের দেখতে হবে, সেখানে কী ধরনের সরকার গঠন হচ্ছে৷ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের কীভাবে দেখছে৷ কী ধরনের সম্পর্ক তারা করতে চাচ্ছে তালেবানের সঙ্গে৷ এগুলো পর্যবেক্ষন করার পরই বাংলাদেশ ধীর গতিতে সিদ্ধান্ত নিতে পারে তাদের স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে৷ যেহেতু আফগানিস্তান সার্কের মেম্বার, সে হিসেবে তাদের সঙ্গে আমাদের ভালো বাণিজ্যিক সম্পর্ক হতেও পারে৷ কিন্তু এটা নির্ভর করবে সেখানে স্থায়ী সরকার হচ্ছে কিনা৷ কয়েকটা প্রেস কনফারেন্সের উপর নির্ভর করে তো আর সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না৷ যার জন্য আমাদের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই৷
তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে বা না গড়তে বাংলাদেশ কি আন্তর্জাতিক কোনো চাপে পড়তে পারে? বাংলাদেশের পক্ষে কি তালেবানকে পুরোপুরি এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ আছে?
মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশকে চাপিয়ে দিয়ে কিছু করাতে পারবে না৷ ওই বাংলাদেশ নেই এখন৷ ইতিমধ্যে আমরা দেখেছি, আমাদের আফগান শরণার্থী নিতে বলেছে, আমাদের সরকার তো সরাসরি না করে দিয়েছে৷ একসময় বলা হয়েছিল, রোহিঙ্গাদের ভাষানচরে নেওয়া যাবে না৷ সেটাও আমরা মানিনি৷ ১০ বা ২০ বছর আগের বাংলাদেশ আর এখনকার বাংলাদেশ এক না৷ ফলে আমি মনে করি, কোনো দেশ আফগানিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক রাখার ব্যাপারে আমাদের যা বলবে, সেটা আমাদের মেনে নিতে হবে বিষয়টি তা নয়৷ তাদের সঙ্গে সম্পর্ক করলে আমাদের লাভ-ক্ষতি হিসাব করেই সিদ্ধান্ত হবে, অন্য কোনোভাবে সেটা হবে না৷
পাকিস্তানে তো তালেবানের শাখা আছে, বাংলাদেশে কোনো শাখা নেই৷ তাহলে কী প্রক্রিয়ায় তালেবান বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারে?
বৈধ সরকার হলে তো কোনো সমস্যা নেই৷ এখন তারা যে সরকার গঠন করবে, সেই সরকার যদি স্বীকৃতি পায় এবং জাতিসংঘের স্বীকৃতি পায়, তাহলে তো আর কোনো ঝামেলা থাকবে না৷ রীতিমতো একটা সুপারপাওয়ারকে ফেলে এখন যে সরকার এলো তাদের সেই সুপারপাওয়ার কতখানি সুযোগ দেবে? তারা কি সহজে মেনে নেবে? আমার মনে হয় না৷ সে তো চাইবে তার জনগণকে দেখাতে, আমি ঠিকই করেছি৷ এখন দেখতে হবে, কতখানি বুদ্ধি রেখে তালেবান সরকার গঠিত হয় বা পরিচালিত হয়৷ তারা এখন যেটা বলছে, সেটা না রাখতে পারলে তখন তো তাদের স্বীকৃতি নিয়েই সমস্যা দাঁড়াবে৷
নারীদের ক্ষেত্রে তালেবানদের যে নীতি, তাতে কি বাংলাদেশে নারীদের উপর কোনো প্রভাব পড়তে পারে?
ওরা তো আজকে স্কুলে গেছে৷ ওরা তো বলছে, নারীরা যেতে পারবে৷ তারা বলছে, ইসলামিক আইন-কানুন মেনে নিয়ে৷ সেটা তো একাধিক দেশে আছে৷ ইরান বা তুরস্কেও তো তাই আছে৷ আমাদের নারীরাও যে বেইসলামিভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে তা কিন্তু না৷ অনেক ফোর্সেস আছে সেখানে, তারা যে এত তাড়াতাড়ি সেখানে স্থিতিশীলতা আনতে দেবে তা কিন্তু না৷ এটা তো একটা বিরাট ঘটনা৷ আমরা হয়ত এখানে বসে বুঝতে পারছি না৷ বিরাট একটা সুপারপাওয়ার, তারপর ন্যাটো ফোর্স সবাই যে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেল এটা তো একটা বিশাল জয়৷ অন্যসময় আমরা দেখেছি সোভিয়েত বাহিনীকে তারা পরাজিত করেছে, তখন কিন্তু পাকিস্তান, সৌদিআরব, এমনকি অ্যামেরিকাও তাদের পেছনে থেকে সরাসরি সহযোগিতা করেছে৷ কিন্তু এবার কেউ তাদের পেছনে সরাসরি ছিল না৷ কেউ তাদের অস্ত্র দিয়ে বা অর্থ দিয়ে কিন্তু প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করেনি৷ এখন আসলে দেখা দরকার তারা কতটা শিক্ষা নিলো৷
তালেবানের এই জয়ে বিশ্বরাজনীতিতে মার্কিন প্রভাব কমে অন্য কোনো রাষ্ট্রের প্রভাব বাড়তে পারে?
এটা তো স্পষ্ট যে, মার্কিন প্রভাব এমনিতেই কমে গেছে৷ ২০ বছর ধরে চেষ্টা করেও আফগানিস্তান তারা দখল করতেই পারলো না৷ এখানে তারা ২ পয়েন্ট ৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে৷ এর মধ্যে ১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে আফগানে একটি আর্মি তৈরি করার জন্য৷ কে তাকে বুদ্ধি দিয়েছে ঈশ্বর জানে৷ সেই পলিসিতে অ্যামেরিকার একটা বড় পরাজয় হয়েছে৷ দেখতে হবে এই পরাজয় সে কতখানি হজম করবে৷ বুঝতে হবে, এই ২ পয়েন্ট ৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছে এর মধ্যে বিরাট একটা অংশ তাদের মিলিটারি কমপ্লেক্স লাভ করেছে৷ অ্যামেরিকায় একটা পুঁজিবাদি ব্যবস্থা৷ বাণিজ্যই তাদের কাছে প্রধান৷ এখানে অস্ত্র বা অন্যান্য লজিস্টিক নিয়ে বিশাল বাণিজ্য হয়েছে৷ এর সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদের সবাই তো অ্যামেরিকার ঠিকাদার৷ এরা ২০ বছর ধরে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেছে৷ এখন এটা যেহেতু থেমে গেল, তাহলে তারা কী করবে? তারা কী অন্য জায়গায় যুদ্ধ করবে? তাদের তো কিছু করতে হবে, তা না হলে তো মুনাফা আরো পড়ে যাবে৷ আমরা দেখছি, সেখানে ডেমক্র্যাটিক পার্টির বেশ কয়েকজন জেগে উঠেছেন৷ তারা প্রশ্ন করছেন- তোমরা সেখানে ২ পয়েন্ট ৫ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ করেছো কীসের জন্য? যদিও এটা বাইডেনের দোষ না৷ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তই তারা মেনে নিয়ে বাস্তবায়ন করেছে৷ এখন তারা কী করে সেই জিনিসটা দেখতে হবে৷