উন্নয়নের ঝগড়ায় খরচ হচ্ছে না হাজার হাজার কোটি
১৮ ডিসেম্বর ২০২০পশ্চিমবঙ্গে বিধানসভা ভোটের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বনাম নরেন্দ্র মোদীর লড়াইয়ে নতুন মাত্রা পেয়েছে পুরনো একটি অভিযোগ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়বিভিন্ন উন্নয়নখাতে কেন্দ্রীয় সরকারের দেয়া অর্থ খরচ করেন না। শেষ পর্যন্ত সেই টাকা ফেরত যায়। বিজেপি-র আইটি সেলের প্রধান এবং এখন কেন্দ্রীয় বিজেপি-র তরফে রাজ্যের ভোট নিয়ে বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত অমিত মালবীয় নিয়মিত এই অভিযোগ নিয়ে টুইট করে যাচ্ছেন। সেই অভিযোগ আরো উসকে দিয়েছেন সদ্য তৃণমূল থেকে ইস্তফা দেয়া বিধায়ক এবং আসানসোলের মেয়র জিতেন্দ্র তিওয়ারি। সোচ্চার বিজেপি-র ছোট-বড় সব নেতাই।
রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিমের সঙ্গে বৈঠকে জিতেন্দ্রের অভিযোগ ছিল, আসানসোলের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দেয়া দুই হাজার কোটি টাকা কেন খরচ করা হলো না? এই অর্থ কেন কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে ফেরত গেল? জবাবে ফিরহাদ বলেছিলেন, কেন বিজেপি-র সুরে কথা বলছেন জিতেন্দ্র? জবাবে মেয়র বলেছিলেন, তিনিও বলতে পারেন, ফিরহাদ আসলে পাকিস্তানে ইমরান খানের মতো কথা বলছেন।
রাজনীতিতে এই ধরনের অভিযোগ হয়। অতীতেও হয়েছে। ভবিষ্যতেও হবে। কিন্তু টাকা খরচ না করা নিয়ে যে অভিযোগ জিতেন্দ্র করেছেন, তা যে একেবারে ভিত্তিহীন এমন নয়। যেমন কৃষক সম্মান নিধি। ২০১৯-এর লোকসভা নির্বাচনের আগে নরেন্দ্র মোদী দেশের কৃষকদের জন্য তিন কিস্তিতে বছরে মোট ছয় হাজার টাকা দেয়ার ঘোষণা করেন। পুরোটাই কেন্দ্রের অর্থ। রাজ্য সরকারকে এর মধ্যে একটা টাকাও দিতে হয় না। বাকি প্রায় সব রাজ্যে এই প্রকল্প চালু হলেও পশ্চিমবঙ্গে হয়নি। কারণ, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজি হননি। তিনি উল্টে কৃষকদের জন্য বেশ কিছু সুবিধা দেয়ার কথা ঘোষণা করেন। রাজ্যের কৃষক এখনো বছরে ছয় হাজার টাকা হাতে পান না।
কেন্দ্র বারবার বলা সত্ত্বেও গরিবদের বিনা পয়সায় পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত বিমা দেয়ার প্রকল্প আয়ুষ্মান ভারত রাজ্যে চালু হয়নি। সেখানে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্য হলো, আয়ুষ্মান ভারত প্রকল্পে রাজ্যকে ৪০ শতাংশ টাকা দিতে হয়। কিন্তু এটাকে পুরোপুরি কেন্দ্রীয় প্রকল্প বলে দেখানো হয়। সব কৃতিত্ব নরেন্দ্র মোদী নেন। তার জায়গায় রাজ্য নিজস্ব পরিকল্পনা চালু করেছে। সেখানেও পাঁচ লাখ টাকা করে বিমার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। মমতা এখন রাজ্যের সব মানুষের জন্য এই বিমার ব্যবস্থা করেছেন।
সরকারি সূত্র জানাচ্ছে, নিউ টাউন ও আসানসোলের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারের দেয়া এক হাজার কোটি টাকা ফেরত গেছে। জিতেন্দ্রের অভিযোগ, শুধু আসানসোলেই দুই হাজার টাকার প্রকল্প রাজ্য সরকার করেনি। তবে ঘটনা হলো, রাজ্য সরকার স্মার্ট সিটি প্রকল্প থেকেই সরে গেছে। ফলে তারা কেন্দ্রীয় অর্থ নেয়নি। অমিত মালবীয়ের অভিযোগ, কেন্দ্রীয় সাহায্য সত্ত্বেও জেলাস্তরে শিশুদের জন্য আর্লি ইন্টারভেনশন সেন্টার তৈরি হয়নি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় জলশক্তি মন্ত্রণালয় বারবার তাগাদা দেয়া সত্ত্বেও গ্রামের লোকেদের বাড়িতে পাইপে করে জল পৌঁছে দেয়ার প্রকল্প এগোয়নি। কেন্দ্র এই প্রকল্পে দুই হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা দিতে চেয়েছিল বলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জানিয়েছেন।
কিছুদিন আগে কংগ্রেসের লোকসভার নেতা ও বহরমপুরের সাংসদ অধীর চৌধুরি অভিযোগ করেছিলেন, পরিযায়ী শ্রমিকদের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার সাহায্য দিচ্ছিল। তার জন্য জেলা ধরে ফিরে আসা পরিযায়ী শ্রমিকদের নাম পাঠাতে হতো। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ সরকার সময়ে নাম পাঠায়নি বলে পরিযায়ী শ্রমিকরা সাহায্য পাননি।
দেশের অন্য কোনো রাজ্যে উন্নয়নখাতের টাকা নিয়ে এরকম আমরা-ওরা হয় না। পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম। রাজ্য বিজেপি-র সাধারণ সম্পাদক রাজু বন্দ্যোপাধ্যায় ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''প্রধানমন্ত্রী এর আগে এসে বলে গেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গ উন্নয়নের ক্ষেত্রে স্পিড ব্রেকার তৈরি করেছে। তাই জিতেন্দ্র নতুন কোনো অভিযোগ করেননি। মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের কোনো কাজ পশ্চিমবঙ্গে হতে দেন না। কৃষকদের টাকা দেন না। আয়ুষ্মান ভারত রূপায়ণ করেননি। এটা হয়েই চলেছে।''
তৃণমূলের প্রবীণ সাংসদ সৌগত রায় অবশ্য এই সব অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন। ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ''জিতেন্দ্র তিওয়ারিরা কী বলেছেন তাতে কিছু এসে যায় না। তাঁর এত সমস্যা হলে কেন দলের মধ্যে আগে বলেননি। বোঝাই যাচ্ছে, এ সবই হলো দলবদলের কৌশল।''
তবে সৌগত যত সহজে অভিযোগ উড়িয়ে দিচ্ছেন, বিষয়টি কি ততই লঘু? প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র মনে করেন, দুই পক্ষের কথাতেই কিছুটা সত্য আছে। কেন্দ্রীয় প্রকল্পে যেখানে রাজ্যও টাকা দেয়, সেখানে তাদেরও কৃতিত্ব দেয়া উচিত। মোদী মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় বারবার সেই দাবি করেছেন। আর পুরোপুরি কেন্দ্রের টাকায় প্রকল্প হলে তা অবশ্যই রাজ্য সরকারের রূপায়ণ করা উচিত।
রাজ্যের অনেক বিশেষজ্ঞই মনে করেন, রাজনীতির মান এতটাই নেমেছে যে, কোনো সরকারই বিরোধী পক্ষকে কৃতিত্ব দিতে রাজি নয়। তার জন্য ক্ষতিটা হয় রাজ্যের মানুষের। শুভাশিস মনে করেন, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারগুলি আলোচনার মাধ্যমে এই বিরোধ মিটিয়ে নিতেই পারেন। উন্নয়নের মধ্যে এই রাজনীতির প্রবেশ অনভিপ্রেত।