কলকাতা মেট্রোতে ঘন ঘন আত্মহত্যা কীভাবে বন্ধ হবে?
৭ জানুয়ারি ২০২৫ভারতের প্রথম মেট্রোর পরিষেবা শুরু হয় কলকাতায়। ১৯৮৪ সালের ২৪ অক্টোবর থেকে যে রেলের যাত্রা শুরু, তার গতি মাঝেমধ্যেই থমকে যাচ্ছে আত্মহত্যার জেরে। এমনই আরেকটি ঘটনা ঘটল সপ্তাহের প্রথম দিনে।
সোমবারের আত্মহত্যা
দুপুর বারোটা নাগাদ চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনের কাছে লাইনে ঝাঁপ দেন এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি। পঞ্চাশের কাছাকাছি তার বয়স। ট্রেন যখন স্টেশনে ঢুকছে, ঠিক সেই সময়ে লাইনে নেমে পড়েন তিনি। ট্রেনের নিচে তার দেহ আটকে যায়। লাইন ও প্লাটফর্মের মাঝের অংশে দেহ এমনভাবে আটকে ছিল যে, মাথা ছাড়া বেশিরভাগ অংশই দেখা যাচ্ছিল না।
দেহে প্রাণ আছে কি না, সেটা পরীক্ষা করার জন্য চিকিৎসককে ডাকা হয়। তিনি মৃত্যু নিশ্চিত করার পর দেহ বার করা হয় ট্রেনের নিচ থেকে। এ জন্য বিদ্যুৎ সংযোগ সম্পূর্ণ ছিন্ন করতে হয়েছিল। দেহ উদ্ধার কীভাবে হবে, সেটা ঠিক করতেই দীর্ঘ সময় লেগে যায়। এর ফলে ঘন্টা দুয়েকের মতো সময় আংশিক বন্ধ থাকে মেট্রো পরিষেবা।
দিনের ব্যস্ত সময় মাঝেমধ্যেই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে কলকাতা মেট্রোয়। এর ফলে চূড়ান্ত ভোগান্তির মুখে পড়েন যাত্রীরা। সোমবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
গত মাসে নিউ গড়িয়াগামী মেট্রোর সামনে শোভাবাজার স্টেশনে ঝাঁপ দেন এক ব্যক্তি। চাঁদনি চক মেট্রো স্টেশনে মেয়ের হাত ছেড়ে এক নারী লাইনে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। গত বছর শিশুকে কোলে নিয়ে এক মা আত্মহত্যা করেছিলেন।
মেট্রোর নিরাপত্তা
আত্মহত্যার চেষ্টা অনেক সময় রুখে দিতে সফল হন সুরক্ষাকর্মীরা।
গত পয়লা নভেম্বর, কালীপুজোর দিনে কালীঘাট মেট্রো স্টেশনে লাইনে ঝাঁপ দিতে গিয়েছিলেন এক প্রবীণ। ঝাঁপ দেয়ার মুহূর্তে তাকে ধরে ফেলেন কর্তব্যরত রেল সুরক্ষা বলের কর্মী। প্রাণে বেঁচে যান ওই বৃদ্ধ। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আত্মহত্যা রোখা সম্ভব হয় না।
মেট্রো সফরের চার দশকে কয়েকশো মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন স্টেশনে স্টেশনে। অনেকের প্রাণ গিয়েছে, কয়েকজনকে বাঁচানো সম্ভব হয়েছে। যদিও কখনো ১০০ শতাংশ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়নি।
সম্প্রতি মরণঝাঁপ ঠেকাতে একাধিক উদ্যোগ নিয়েছে মেট্রো রেল। স্টিলের গার্ডরেল বসানো হয়েছে কালীঘাট স্টেশনে।
ডাউন প্ল্যাটফর্মে পরীক্ষামূলক ভাবে এই গার্ডরেল বসানোর কাজ শুরু হয়। আগামীতে সমস্ত স্টেশনে গার্ডরেল' বসানো হতে পারে। যদিও এই ব্যবস্থা আত্মহত্যা ঠেকাতে কতটা কার্যকরী, সেই প্রশ্ন উঠেছে।
আবার অনেকে এই গার্ডরেলের ব্যবহার নিয়ে আপত্তি তুলেছেন। যাত্রীদের একাংশের মতে, গার্ডরেলের জেরে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। ভিড়ের মধ্যে ট্রেনে ওঠার সময়ে ধাক্কা লাগতে পারে গার্ডরেলে। এতে হিতে বিপরীত হতে পারে।
এই আশঙ্কা এড়াতে মেট্রো সুরক্ষার বিষয়টিকে আরো বেশি প্রচারে নিয়ে আসবে বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। যাত্রীরা ট্রেন ধরতে যাওয়ার সময় মাইকিং করা হবে।
ইস্ট–ওয়েস্ট মেট্রো করিডরে প্ল্যাটফর্মের দু'ধারে কাচের প্রাচীর আছে। একে বলা হয় প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর। ট্রেন স্টেশনে ঢুকলে এই দরজা পাশাপাশি খুলে যায়। খোলার পর সামনে মেলে ট্রেনে প্রবেশের দরজা। গ্রিন লাইনের ক্ষেত্রেও এমন ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলি পরে তৈরি হওয়ায় আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করা গিয়েছে। কিন্তু পুরোনো মেট্রো বা ব্লু লাইন বহু আগে তৈরি হওয়ায় এই ব্যবস্থা নেই।
মেট্রো রেল সূত্রে ডিডাব্লিউর কাছে দাবি করা হয়েছে, প্রতিটি স্টেশনে সিসিটিভি মনিটরিং করা হয়। কারো অস্বাভাবিক গতিবিধি দেখলে সংশ্লিষ্ট স্টেশনকে জানানো হয়। আরপিএফ কর্মীর সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। প্ল্যাটফর্ম টিভি, ফ্লেক্সের মাধ্যমে সচেতনতামূলক প্রচার চালানো হচ্ছে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য, যখন প্ল্যাটফর্মে কোনো ট্রেন নেই, তখন হলুদ রেখা যাতে কেউ অতিক্রম না করেন, সেটা বোঝাতেই গার্ডরেল রাখা হয়েছে। এটা শুধু কালীঘাট স্টেশনে রয়েছে। হাওড়া ময়দান থেকে সল্টলেক সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত মেট্রোর গ্রিন লাইন চালু হয়েছে। এর মধ্যে এসপ্ল্যানেড ও শিয়ালদা মাঝের অংশটুকু ছাড়া বাকিটায় পরিষেবা দেয়া হচ্ছে। গ্রিন লাইনে প্ল্যাটফর্ম স্ক্রিন ডোর রয়েছে।
মনের সমস্যা
আত্মহত্যা একটা সামাজিক অসুখ। শুধু রেল লাইনকে নিরাপত্তায় মুড়ে এই সমস্যাকে দূর করা সম্ভব নয়। এতে শুধু মৃত্যুর সংখ্যা কমানো যেতে পারে
মনো-সমাজকর্মী মোহিত রণদীপ ডিডাব্লিউকে বলেন, "কোনো মানুষ যখন জীবন সম্পর্কে সম্পূর্ণ আশা হারায়, জীবন যখন তাকে কিছু দেয় না, তখন অনেক ক্ষেত্রেই তিনি আত্মহননের পথ বেছে নেন। সেই সময়ে তিনি আত্মহত্যার নিশ্চিততম পথ বেছে নিতে চান। মেট্রো বেছে নেয়ার কারণ সহজলভ্যতা, অর্থাৎ সহজে মৃত্যুকে বরণ করা যায়। অল্প সময়ের মধ্যে আত্মহত্যা করা যায়। যে ভোল্টের বিদ্যুৎ থাকে লাইনে, তার সংস্পর্শে এলে বাঁচার সম্ভাবনা খুবই কম। একটা আত্মহত্যা আর একটা আত্মহত্যাকে ডেকে আনে। একজন যে পদ্ধতিতে আত্মঘাতী হন, সেটা অন্য কোনো অবসাদগ্রস্ত মানুষকে প্ররোচিত করে।"
যাত্রীর দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি বলেন, "যতক্ষণ পর্যন্ত না ট্রেন আসছে, ততক্ষণ মেট্রোর লাইন ওপেন থাকে। নতুন মেট্রোতে এই সমস্যা নেই। রেল কর্তৃপক্ষ যদি সব স্টেশন স্ক্রিন ডোর দিয়ে ঘিরে দেন, তা হলে আত্মহত্যার প্রকোপ কমবে।"
স্ক্রিন ডোরকে ইন্টেলিজেন্স ফেন্স হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। পরিবহণ বিশেষজ্ঞ, অধ্যাপক পার্থপ্রতিম বিশ্বাস ডিডাব্লিউকে বলেন, "আমাদের শহরে ইন্টেলিজেন্স ফেন্স করতে হবে। যখন ট্রেন ঢুকবে, তখন ফেন্স খুলে যাবে। যখন ট্রেন থাকবে না, বন্ধ থাকবে। এর ফলে ঝাঁপ দেয়ার সুযোগ থাকবে না। ঝাঁপ দেয়া দূরের কথা, খালি চোখে প্ল্যাটফর্ম থেকে দেখাই যাবে না লাইন।"