খাবারে ফর্মালিন, বিষ ঢুকছে শরীরে
৩১ জুলাই ২০১৮সন্দেহ ছিল অন্ধ্রপ্রদেশে মাছে ফর্মালিন দেওয়া হচ্ছে৷ কিন্তু অন্ধ্রপ্রদেশ সরকারের পাশাপাশি মৎস্য উৎপাদন, ব্যবসায়ী ও প্যাকেজিং সংগঠনগুলি দাবি করেছে, অন্ধ্রের ব্যবসায়ীরা সচেতনভাবেকখনই মাছে বিষাক্ত রাসায়নিক মেশাবেন না৷ ঘটনাটি ঘটছে পশ্চিমবঙ্গেরই কোনো অংশে৷ যদিও গত সপ্তাহে অন্ধ্রপ্রদেশের মাছ নিয়ে আপত্তি তুলেছে অসম৷ তারা অন্ধ্র থেকে আসা মাছ নিষিদ্ধ করেছে৷ রোজ অসমে ২,৪০০ টন মাছ আসে অন্ধ্র থেকে৷ এই মাছের নমুনা পাঠানো হয়েছে ফরেনসিক পরীক্ষার জন্য৷
বাঙালি রসনাপ্রিয় জাতি৷ কিন্তু সবেতেই যদি ফর্মালিন বা অন্য রাসায়নিকের চোখ রাঙানি থাকে, তাহলে তো বিষম সমস্যা! এই সমস্যার মুখে দাঁড়িয়ে ডয়চে ভেলে খোঁজ নিয়ে দেখল, কী বলছেন বিশেষজ্ঞ এবং সাধারণ মানুষ?
ফর্মালিনের ব্যবহার পশ্চিমবঙ্গে অনেক পুরানো৷ তবে তা আইনসম্মত বা বৈজ্ঞানিক উপায় নয়৷ গত ৫-৭ বছরে ফর্মালিনের ব্যবহার বহুল অংশে বেড়েছে বলে জানা গেছে৷ ফর্মালিন প্রয়োগের আগে বরফ, ইউরিয়া বা নুন দিয়ে মাছ সংরক্ষণ করা হতো৷ কিন্তু এখন কলকাতাসহ রাজ্যের বিভিন্ন বাজারে বিভিন্ন মাছে পাওয়া যাচ্ছে ফর্মালিন৷ এ অভিযোগ কোনো মৎস্য ব্যবসায়ী সরাসরি স্বীকার করেননি৷ এ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতার এক মৎস্য ব্যবসায়ী স্বীকার করলেন যে, মাছের পচন রোধে ফর্মালিন ব্যবহার করতে হয়৷ আগে সেটা কেবল স্প্রে করা হতো বা মাখানো হতো, কিন্তু এখন তা ইনজেকশনের মাধ্যমে মাছের দেহের ভেতর চালান করা হয়৷
তবে কি মাছ খাওয়া ছেড়ে দিচ্ছে বাঙালি? বেহালা বকুলতলা বাজারে দীর্ঘদিনের বাজারের অভিজ্ঞতা থেকে মুরারীমোহন সামন্ত ডয়চে ভেলেকে জানালেন, জ্যান্ত মাছের বিক্রি বাড়লেও তবে একেবারে বরফের মাছের বিক্রি কমে যাচ্ছে, এমনটা নয়৷ এছাড়া বেশিরভাগ মানুষেরই ধারণা, মাত্র দু-এক পিস মাছে কত আর ফর্মালিন শরীরে ঢুকবে! উচ্চ তাপমাত্রায় সমস্ত ব্যাকটিরিয়া নষ্ট হয়, কাজেই মাছে ফর্মালিন থাকলে তাও নষ্ট হবে, আশা করা যায়!
সত্যিই কি তাই? মানবশরীরে ফর্মালিনের ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে না? এ ব্যাপারে বিশিষ্ট চিকিৎসক ফুওয়াদ হালিম বললেন, ‘‘ভাগাড় কাণ্ডের রিপোর্ট এখনও আমাদের হাতে আসেনি৷ তবে সেই মাংস যে ফর্মালিনে চোবানো হতো, তাতে সন্দেহ নেই৷ কিন্তু মাংস শুধু ধুয়ে নিলেই যে ফর্মালিন চলে যাবে তা তো নয়, মাংসের ভেতরকার সেই ফর্মালিন কিন্তু মানব শরীরে ঢুকেছে৷ পাশাপাশি মাছ-মাংসের ক্ষেত্রে হিমাঙ্কের নির্দিষ্ট প্যারামিটার মেনে চলাটাও জরুরি৷ সেটা না হলে বিভিন্ন ক্ষতিকারক ব্যাকটিরিয়া বা ছত্রাক বাসা বাঁধে৷ এটাই হয়েছে ভাগাড়ের মাংসে৷ এর ফলে কিডনি, লিভার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে যেমন, তেমনি বাড়ছে ক্যানসারের আশঙ্কা৷ মাছের ক্ষেত্রেও এমনটা স্বাভাবিক৷''
কিন্তু বাঁচার উপায় কী তবে? পশ্চিমবঙ্গ প্রাণী ও মৎস্যবিজ্ঞান বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শিবকিঙ্কর দাস এ ব্যাপারে বলেন, ‘‘সত্যি বলতে তো ফর্মালিনের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচার উপায় নেই৷ তবে কিছু টোটকা আছে৷ যেমন ইলিশ মাছের কথাই বলতে গেলে প্রথমেই বলব, বাজারে খেয়াল রাখতে হবে ইলিশ মাছে মাছি বসছে কিনা৷ ফর্মালিন দেওয়া মাছে মাছি বসবে না৷ ফর্মালিন যুক্ত মাছ, বিশেষ করে ফর্মালিন ইনজেকশন দেওয়া মাছ শক্ত হবে৷ একটু নরম ইলিশ মাছে ফর্মালিন থাকে না৷ ফর্মালিন দেওয়া ইলিশ মাছের চোখ কালো হবে৷ স্বাভাবিক ইলিশ মাছের চোখ কালচে লাল বা ঘোলাটে হবে৷''
অধ্যাপক জানান, শুঁটকি মাছের ক্ষেত্রে এ দেশে ফর্মালিন প্রয়োগ অব্যর্থ৷ অ্যামেরিকার মতো দেশে শুঁটকি জাতীয় মাছ তৈরির পদ্ধতি পুরো আলাদা৷ ইলেকট্রিক ড্রায়ারের মাধ্যমে ওখানে মাছ শুকনো করা হয়, তাই ওখানকার মাছে কোনো গন্ধও হয় না৷ কিন্তু আমাদের মতো দেশে শুঁটকি মাছ তৈরির পদ্ধতি বিজ্ঞানসম্মত না হওয়ায় ফর্মালিন স্প্রে করতে হয়৷
কিন্তু এ সবে জীববৈচিত্র্যে পরিবর্তন আসতে পারে কি? তিনি বলেন, ‘‘শুঁটকি মাছের গুঁড়ো গবাদি পশু, মুরগি এবং মাছের খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়৷ যখনই তা জলে মিশে যায়, ফর্মালিন পুকুর বা জলাশয়ের জলকে দূষিত করে৷ এরকমভাবে মিষ্টি জলের মাছ যেমন, রুই, কাতলা, ব্রিগেড ইত্যাদি ধরার জন্য পুকুরে বিষ প্রয়োগ করা হয়৷ তা মাছগুলোকে অর্ধসচেতন রাখলেও তা আদতে বিষক্রিয়ার ফল৷ এতে পুকুরের বাস্তুতন্ত্রের ক্ষতি হয়৷''
তাহলে একটা প্রশ্ন উঠেই যায়, মানুষ খাবে কী? ডায়েটিশিয়ান ঈপ্সিতা চক্রবর্তী বললেন, ‘‘প্রোটিন আমরা কোনোমতেই বন্ধ করতে পারি না৷ এটা খুবই দরকারি৷ তাই মাছ-মাংস বন্ধ করার প্রশ্ন আসছে না৷ ভাগাড় কাণ্ডের পর একান্তই যারা মাংস বা মাছ খাওয়া ছাড়ছেন তাঁদের জন্য দ্বিতীয় শ্রেণির প্রোটিন দিই৷ দুগ্ধজাত প্রোটিন বা বাজারের সাপ্লিমেন্টাল কমার্শিয়াল প্রোটিন তখন দিতে হয়৷ কিন্তু এ সব সবার পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না৷ কিন্তু বড় বড় হাসপাতালে যেখানে প্রতিদিন কয়েক হাজার রোগীকে দৈনিক মাছ বা মাংসের যোগান দিতে হয়, সেক্ষেত্রে এটা সম্ভব নয়৷ এ প্রসঙ্গে তাঁর মত, বাজারে দেখে যদি জ্যন্ত মুরগি বা মাছ কেনা হয়, তার বিকল্প নেই৷ তবে এক্ষেত্রে সেটা সম্ভব হয় না বলেই সাপ্লায়ারের ওপর নির্ভর করতে হয়৷ নিয়মিত ভাবে যারা তা সাপ্লাই করেন, তাদের ওপর ভরসা করতেই হয়৷
ঈপ্সিতা সাধারণ মানুষের উদ্দেশে বললেন, ‘‘আমাদের সচেতনতার অভাব আছে তো বটেই৷ খবরের কাগজ বা টিভি দেখে জনমনে একটা আতঙ্ক ছড়িয়েছে৷ তবে এতে মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ করে দেওয়ার কোনো দরকার নেই৷ সবজিতেও কীটনাশক দেওয়া হয়, তা সত্ত্বেও যখন সবজি খেতে হচ্ছে, তখন মাছ-মাংস বন্ধ করবেন কেন? টাটকা জিনিস কিনে খান৷ বাসি বা বরফের জিনিস এড়িয়ে চলুন৷''
কিন্তু ফর্মালিন এড়িয়ে চলা কি এত সহজ? সরকারি তরফে যেখানে কোনও উদ্যোগ নেই, মানুষের সচেতনতা নেই, সেখানে বাড়তি লোভের তাড়নায় নিজেদেরই বিপদ ডেকে আনার অসাধু প্রয়াস রোখার কোনো পথ দেখা যাচ্ছে না৷ তৃতীয় বিশ্বে হয়ত এটাই দস্তুর, যেখানে প্রতিদিন পাতে পড়ার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে ভাগাড়ের মাংস বা ফর্মালিন দেওয়া মাছ৷