টোটোতে অসুস্থ স্ত্রীকে নিয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় বৃদ্ধ
১৪ নভেম্বর ২০২৪
অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করার সামর্থ্য না থাকায় নিজের টোটোয় সওয়ারি করলেন স্ত্রীকে। কবে পর্যাপ্ত চিকিৎসা পরিষেবা পাবেন জেলার মানুষ?
রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিকাঠামো উন্নত করার দাবিতে আন্দোলন এখনো চলছে। জুনিয়র চিকিৎসকরা বারবার বলেছেন, তাদের আন্দোলন রোগীদের স্বার্থে। আজ জেলায় জেলায় পর্যাপ্ত পরিকাঠামো গড়ে না ওঠায় একটা অংশের মানুষ কলকাতায় আসেন। সেক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়েন গরিব মানুষ। রোগীর স্থানান্তরের ক্ষেত্রে যে তারা কতটা অসহায়, সেটা প্রমাণ করে দেয় মুর্শিদাবাদের প্রবীণের দীর্ঘ সফর।
অ্যাম্বুল্যান্সের বদলে টোটো
মুর্শিদাবাদের সালার থানার সোনারুললি গ্রামে থাকেন উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়। তার স্ত্রী কিডনির সমস্যায় ভুগছেন অনেক দিন। ওই জেলার কেতুগ্রাম গ্রামীণ হাসপাতালে চিকিৎসা চলেছে তার। পরিস্থিতি গুরুতর হওয়ায় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে রেফার করা হয় বৃদ্ধাকে। এতে অনিশ্চয়তায় পড়েন উপেন।
বর্ধমানে ঠিকঠাক চিকিৎসা মিলবে না, এই আশঙ্কায় তিনি কলকাতায় আসার সিদ্ধান্ত নেন। কিন্তু অ্যাম্বুল্যান্স ভাড়া করার সামর্থ্য নেই তার। তাই নিজের টোটোতে স্ত্রীকে বসিয়ে রওনা হন। বিকেল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ সালার থেকে যাত্রা শুরু করেন তিনি। রাত বারোটা নাগাদ টোটোর চার্জ ফুরিয়ে আসে। তাকে থামতে হয় হুগলি জেলার ডানকুনিতে।
সেই সময় স্থানীয়দের নজরে পড়েন উপেন। তাকে জিজ্ঞেস করলে সমস্যার কথা সামনে আসে। উপেন বলেন, ''আমার স্ত্রীর কিডনির সমস্যা। পা ফুলে আছে। বারবার বমি হচ্ছে। আমি ওখানে রাখতে ভরসা পেলাম না। তাই কলকাতায় নিয়ে যাচ্ছি।''
কিন্তু টোটো করে কেন? উপেন বলেন, ''অ্যাম্বুল্যান্স অনেক ভাড়া চাইছে। এতো টাকা কোথায় পাবো। তাই নিজের টোটো চালিয়ে আসছি।'' মুর্শিদাবাদ থেকে কলকাতায় আসতে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া প্রায় হাজার তিনেক টাকা।
বৃদ্ধ যখন তার সমস্যার কথা বলেন, সেই খবর পৌঁছে যায় স্থানীয় পুরসভার কাছে।
ডানকুনি পুরসভার চেয়ারপার্সন হাসিনা শবনমের নির্দেশে অ্যাম্বুল্যান্সের ব্যবস্থা করা হয়। বৃদ্ধার স্ত্রীকে মধ্যরাতে পাঠানো হয় কলকাতার মেডিক্যালে।
অতীতের নজির
অ্যাম্বুল্যান্সের খরচ যোগাতে না পারায় দরিদ্র মানুষের দুর্দশার এমন ছবি আগেও ধরা পড়েছে। জলপাইগুড়ি জেলা হাসপাতালের একটি ঘটনায় হইচই পড়ে গিয়েছিল। গত বছর এই হাসপাতালে মারা যান লক্ষ্মী দেওয়ান। পরিবারের শববাহী শকটের খরচ যোগানোর সামর্থ্য ছিল না। তাই রোগীর স্বামী ও পুত্র লক্ষ্মীর দেহ কাঁধে নিয়ে হাসপাতাল থেকে বাড়ির পথে রওনা দেন।
অন্য রাজ্যেও এই নমুনা আছে। গত সেপ্টেম্বরে দুই অসুস্থ শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য ১৫ কিলোমিটার পথ হাঁটতে হয়েছিল এক দম্পতিকে। মহারাষ্ট্রের গড়চিরৌলির ঘটনা। এতটা পথ হেঁটে অতিক্রম করায় অনেকটা সময় নষ্ট হয়। শিশুদের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। হাসপাতালে আনার পর তারা মারা যায়। অ্যাম্বুল্যান্স থাকলে হয়তো দুটি প্রাণ বাঁচানো যেত।
সপ্তাহ দুয়েক আগে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী উত্তর ভারতের ঋষিকেশ এইমসে চালু করেছেন হেলিকপ্টার অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা। এর সাহায্যে উত্তরাখণ্ডের ১৩টি জেলায় পার্বত্য অঞ্চলের রোগীদের চিকিৎসার জন্য অন্যত্র নিয়ে যাওয়া যাবে। ঢাকঢোল পিটিয়ে এই পরিষেবা শুরু হলেও উপেনদের মত মানুষ ২০০ কিলোমিটার আসার জন্য অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবা নিতে পারেন না স্রেফ অর্থাভাবে।
রেফারের রোগ
শুধু অ্যাম্বুল্যান্স পরিষেবায় রোগীকে অন্য জায়গায় পৌঁছে দেয়াই নয়, জেলা হাসপাতালে চিকিৎসা পরিকাঠামো নিয়ে অনাস্থা উঠে এসেছে উপেন বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথায়। তার স্ত্রীর কিডনির সমস্যার চিকিৎসা মুর্শিদাবাদের হাসপাতালে হবে না বলেই তাকে বর্ধমান মেডিক্যালে পাঠানো হয়। বিভিন্ন জেলার ছবি কি এমনই?
ওয়েস্ট বেঙ্গল জুনিয়র ডক্টরস ফ্রন্ট-এর সদস্য ডাক্তার বৈশালী বিশ্বাস বর্তমানে রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে কর্মরত। তিনি ডিডাব্লিউকে বলেন, "রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজ বীরভূমের একটা বড় অংশকে সার্ভিস দেয়। এটা টারসিয়ারি হাসপাতাল হওয়া সত্ত্বেও তার যে সমস্ত পরিকাঠামো বা সুবিধা আছে, সেটা কলকাতার একটা মেডিক্যাল কলেজের সমতুল নয়। এখানে একটা সুপার স্পেশালিটি বিল্ডিং দাঁড় করিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে শুধুমাত্র মেডিসিন আছে, কার্ডিয়লজি নেই। অন্যান্য সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে যেগুলো থাকা দরকার, সেগুলো কোনটাই নেই।"
এই ছবি বীরভূম হোক বা মুর্শিদাবাদ, সর্বত্র মোটামুটি একই বলে দাবি চিকিৎসকের। তিনি বলেন, "এই রেফারেল সিস্টেম শুধু একটা পেশেন্টকে রেফারই করতে পারবে। কিন্তু ২০০ কিলোমিটার দূর থেকে অর্থাৎ যখন রামপুরহাট থেকে তাকে কলকাতায় নিয়ে আসতে হয়, তার অবস্থা তো ওখানেই খারাপ হয়ে যায়। আমাদের আন্দোলনের একটা প্রশ্ন এটাও ছিল যে জেলার একটা মেডিক্যাল কলেজ থেকে কেন কলকাতায় রেফার করতে হবে? তার ইনফ্রাস্ট্রাকচার কেন কলকাতার একটা মেডিক্যাল কলেজের মতো হবে না? তাহলেই তো সেখানে অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।"
জুনিয়র চিকিৎসকরা কেন্দ্রীয় রেফারেল ব্যবস্থা চালুর দাবি জানিয়েছেন। পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে সেটা কোথাও কোথাও চালু হয়েছে। বৈশালী বলেন, "শুধু রেফারেল সিস্টেম করে দিলেই তো সমস্যার সমাধান হয় না। সেখানে প্রপার মনিটারিং বডি, সেই রিক্রুটেড বডিতে কারা থাকবে, কীভাবে পরিচালিত হবে, এটা ধোঁয়াশার মতো ব্যাপার। পাশাপাশি বেড সংখ্যাও বাড়ানো হয়নি। কলকাতাতে বেড না বাড়ানো হলে কী হবে? তাহলে তো রোগীকে মালদা মুর্শিদাবাদ বা যে কোনো পেরিফেরাল হসপিটালে বসে থাকতে হবে।"
উপেন বন্দোপাধ্যায়ের স্ত্রী কি তার কিডনির সমস্যার চিকিৎসা জেলার হাসপাতালে পেতে পারতেন না? বৈশালীর বক্তব্য, "জেলা হাসপাতালগুলোতে একটা অংশের চিকিৎসা দেওয়া হয়। রামপুরহাট মেডিক্যাল কলেজে যেমন ডায়ালিসিস দেয়া হয়। কিন্তু তারপর পরবর্তী চিকিৎসার জন্য একজন নেফ্রোলজিস্টের তত্ত্বাবধান বা সিসিইউ বেড দরকার হলে, তা পর্যাপ্ত নেই। তাই রেফার করতে হয়। রোগীরাও ভরসা পান না।"
অ্যাসোসিয়েশন অফ হেলথ সার্ভিস ডক্টরসের সাধারণ সম্পাদক চিকিৎসক উৎপল বন্দ্যোপাধ্যায় ডিডাব্লিউকে বলেন, "শুধু জেলা থেকে কলকাতায় রোগী রেফার হয় না। কলকাতার মধ্যেও রোগীরা দিনভর ঘোরাঘুরি করে বেড পান না। আবার অ্যাম্বুল্যান্স না পেয়ে মুর্শিদাবাদ থেকে টোটো চালিয়ে কলকাতায় আসেন কেউ। এই সব ঘটনাগুলোই প্রমাণ করে যে আমাদের রাজ্যের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অস্থিচর্ম সার পরিস্থিতি।"
তার অভিযোগ, "জেলাগুলিতে মেডিক্যাল কলেজ বা সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল আছে। তবে যে ব্যবস্থা করলে রোগীরা সেখানে চিকিৎসা পাবে, সেগুলো নেই। রোগী রেফার হওয়া তারই একটা লক্ষণ।"