‘তখন মনে হয়েছিল, সুযোগ পেলে চালককে আমিও পেটাবো’
৯ ডিসেম্বর ২০২২সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি প্রাইভেটকার একজন নারীকে টেনে বহুদূর নিয়ে যায়৷ চালকের এই নির্মমতা দেশের প্রতিটি মানুষকে নাড়া দিয়েছে৷ঘটনার সময় প্রাইভেটকারের পেছনে পেছনে দৌড়ে সেখানে গিয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগ থেকে সদ্য মাস্টার্স পরীক্ষা দেওয়া শ্যামলী রানীও৷ সেখানে গিয়ে তিনি কী দেখেছেন? তার নিজের অনুভুতিই বা কী ছিল? এসব বিষয় নিয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন শ্যামলী রানী৷
ডয়চে ভেলে : সেদিন কী ঘটেছিল?
শ্যামলী রানী : ওই সময় আমরা কয়েকজন মিলে আমাদের রোকেয়া হলের সামনে স্বপন মামার দোকানে চা খাচ্ছিলাম৷ তখন আমরা দেখলাম, অনেক মানুষ, বলতে গেলে সব মানুষ অর্থাৎ চারভাগের তিন ভাগ মানুষ একদিকে দৌড়াচ্ছে৷আমাদের হলের সামনে দিয়ে ভিসির বাড়ির দিকে যাচ্ছে৷ তখন আমার মাথায় কাজ করেছে, চুরি বা ছিনতাই হলে এত মানুষ দৌঁড়াতো না৷ নিশ্চয় কোন দুর্ঘটনা ঘটেছে বা সিরিয়াস কিছু হয়েছে৷ আমরাও যখন পিছন পিছন গেলাম তখন সবাই বলছেন, একটা প্রাইভেটকারে একজন মহিলা আটকে আছেন, চালক তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে৷ তখন সবাই আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে গেছেন৷ এক কথায় সবাই কাঁপছেন৷ এত নৃশংস ছিল ঘটনাটা৷তখন আমরাও পিছন পিছন দৌড়ালাম৷ আমরা যেতে যেতে দেখলাম পুরো রাস্তায় একটা কালো দাগ হয়ে গেছে৷ আমি আবার একটু ভীতু৷ দেখলাম ভিসির বাড়ির সামনে রাস্তায় কিছু একটা পড়ে আছে৷ পরে দেখলাম সেটা ওই নারীর শরীরের কিছু অংশ৷ আমরা যখন ওখানে পৌঁছলাম তখন মানুষ চালককে গণপিটুনি দিচ্ছে৷ তখন ওনার অবস্থা খারাপ হয়ে যায়৷ পরে পুলিশ ভ্যানে করে উনাকে নিয়ে যায়৷
চালককে কোথায় আটকেছিল?
নীলক্ষেতের মোড়ের দিকে যে মুক্তি ও গণতন্ত্র তোরণ হয়েছে ওখানে৷
আপনি পৌঁছে কী দেখলেন?
আমি দেখলাম তখন ড্রাইভারকে গণপিটুনি দেওয়া হয়েছে৷ গাড়িতে তোলা হচ্ছে৷
ওখানে পৌঁছার পর কী আপনার মনে হয়েছে এই গণপিটুনিতে আপনারও অংশ নেওয়া উচিত বা ড্রাইভারকে মারাই উচিত?
আমরা যখন পেছন পেছন যাই তখন তো শুধু রাস্তায় রক্তের দাগ দেখতে পাচ্ছি৷ সেটা দেখেই আমরা অনুমান করতে পারি এটা কতটা নৃশংস ঘটনা ছিল৷ ওখানে যারা ছিলেন রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে সাধারণ পথচারী তাদের সবার চোখে মুখে একটা রোস ছিল৷ তখন আমারও মনে হয়েছিল, আমি পেলে তাকে আমিও পেটাবো৷
ওখানে যাওয়ার পর আপনার কী মনে হয়েছেবিষয়টি পুলিশকে জানানো উচিত?
আসলে কিছু ব্যাপার থাকে যখন মানুষের উপস্থিত বুদ্ধি লোপ পায়৷ পুলিশের ব্যাপারটা আসে পরবর্তী ধাপে৷ এই বিষয়টি এত নারকীয় বা নৃশংস ছিল যখন মানুষের প্রতিশোধ স্পৃহা জেগে ওঠে৷ এটা তো ইচ্ছাকৃত হত্যার মতো ব্যাপারটা৷ উনি বুঝতে পারছেন, তারপরও টেনে নিয়ে যাচ্ছেন৷ হয়ত উনি নিজে বাঁচার জন্য৷ তখন তো আমরা চালকের অবস্থাটা বিবেচনা করছি না৷
গণপিটুনির ভয়ে তো চালক হয়তো থামাননি?
হয়তো তেমনই হবে৷ তার মাথায় হয়তো এটাই কাজ করেছে৷
আমরা মাঝে মধ্যে হিংস্র হয়ে যাই, কেন?
আমরা কয়েক প্রজন্ম ধরে যদি দেখি, আমরা হিংস্র হয়ে বেড়ে উঠছি৷ এর সঙ্গে আসলে অনেক বিষয় আছে৷
বিচার না হওয়ার সংস্কৃতি কি এর জন্য দায়ী?
বিচারহীনতার একটা সংস্কৃতি তো আছেই৷ আমরা দেখি, একটা ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর সেটা কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে৷ এটার কোন রায় বা রায় কার্যকর হওয়ার কোন খোঁজ দেখি না৷ প্রত্যক্ষভাবে না হলেও পরোক্ষভাবে এটা তো অবশ্যই কাজ করে৷ কাউকে আটক করে পুলিশে দিলে আসলে এর কোনো বিচার হবে কিনা সেটাও অনেক সময় কাজ করে৷ ফলে মানুষ চায় নিজেই শাস্তি দিয়ে দিতে৷
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় কম বোধ নিয়ে আমরা বড় হচ্ছি কিনা?
গত কয়েক বছর ধরে আমাদের নৈতিকতা, বোধ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে৷ স্মার্টফোন বা সামাজিক মাধ্যমের কারণে আমরা কেমন জানি আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছি৷ গভীর ভাবনা ও চিন্তার বিষয়টি গড়ে উঠছে না৷ বাবা-মায়ের ক্ষেত্রেও এমন হচ্ছে৷
বাড্ডার রেনু বেগমের কথা আমরা জানি৷ কিছু বুঝে উঠার আগেই গণপিটুনির এই সংস্কৃতিকে আপনি কিভাবে দেখেন?
এটা তো অবশ্যই নেতিবাচক৷ খারাপ একটা দিক৷ আমরা তো দেখেছি, রেনু বেগম নিজের মেয়েকে আনতে স্কুলে গিয়েছিলেন৷ অথচ গণপিটুনি দিয়ে তাকে মেরেই ফেলা হয়েছে৷ এমন তো কখনই হওয়া উচিৎ না৷ বিচারের দায়িত্ব নিজের হাতে নেওয়া উচিৎ না৷ ভেবে চিন্তে রায়টা আসা উচিৎ৷ কিন্তু দেশের যে অবস্থা বা নতুন প্রজন্মের রগচটা হয়ে বেড়ে উঠাসহ বিভিন্ন বিষয় এখানে কাজ করে৷ নিজে দায় নিয়ে নেওয়ার বিষয়টি তো অবশ্যই নেতিবাচক৷
রাষ্ট্রে যদি সঠিক গণতান্ত্রিক চর্চা না হয়, তাহলে মানুষের মধ্যেও এর প্রতিফলন হয়?
অবশ্যই৷ রাষ্ট্রের ইস্যুগুলো মানুষের বেড়ে উঠার ক্ষেত্রে, চিন্তার ক্ষেত্রে প্রভাবিত করে৷
আপনি যখন দেখলে একজন মানুষকে গণপিটুনি দিয়ে পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে, তখন আপনার অনুভুতি কেমন ছিল?
আমার কোন সময়ই মনে হয়নি, তাকে পুলিশে দেওয়া উচিৎ ছিল৷ একটু আগেও যেটা বললাম, রাষ্ট্রের অবস্থা, বিচারহীনতার সংস্কৃতি সবকিছু না ভেবেই আমি যদি বলি, তাহলে বলব, তখন চালকের প্রতি আমার কোন সমবেদনা ছিল না৷ সবাই যে পিটুনি দিয়েছে সেটা আমার মনে হয়েছে যে ঠিক আছে৷