1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

গণপিটুনিতে মানুষ মরছেই, তাকে থামাবে কে?

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড়
৯ ডিসেম্বর ২০২২

পুলিশের খাতায় হিসাব না থাকলেও ভারতে গণপিটুনিতে মানুষের মারা যাওয়াটা ঘোর বাস্তব৷ গণপিটুনির পিছনে রয়েছে গুচ্ছের কারণ৷

https://p.dw.com/p/4Khqj
একুশ শতকে এসেও ভারতে গণপিটুনিতে মানুষ মারা যান
একুশ শতকে এসেও ভারতে গণপিটুনিতে মানুষ মারা যানছবি: Imago/Hundustan Times

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসিমহা রাওয়ের একটা কথা প্রায় অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদের মতো হয়ে গেছে৷ তা হলো, আইন আইনের পথে চলবে৷ বাস্তব হলো, আইন তার নিজস্ব পথে চলার আগেই তো একদল মানুষ তা নিজের হাতে তুলে নিয়ে  পিটিয়ে মারে অন্যদের৷ গণপিটুনি৷ এই গণ মানে কতজন তার কোনো ঠিক ব্যাখ্যা নেই৷ পাঁচজনও গণ, পঁচিশজনও গণ, তার থেকে বেশি-কমও গণ৷

তা সেই পাঁচ থেকে পঁচিশ বা ১২৫ জন কাদের পিটিয়ে মারছে, কেন মারছে? এর জবাবও ভারি গোলমেলে৷ ভারতে গরুচোর সন্দেহে পিটিয়ে চার বছরে অন্তত ৪০ জনকে মারা হয়েছে৷ আর বিভিন্ন ধরনের গুজবের কারণে দুই বছরে ৩৬ জনকে পিটিয়ে মারা হয়েছে৷

তাই বলছিলাম, আইন তার নিজস্ব গতিতে চলার আগেই মানুষের প্রাণ চলে যাচ্ছে৷ ফ্রিজে গরুর মাংস রাখা আছে, এই গুজবের জেরে মরতে হয়েছিল আখলাককে৷ মানুষ পিটিয়ে মেরেছিল তাকে৷ গণপিটুনি৷তার ফ্রিজে কীসের মাংস আছে, আদৌ আছে কিনা, সেসব খোঁজের কী দরকার! গুজব রটে গেলো৷ আর অমনি প্রচুর মানুষ জড়ো হয়ে পিটিয়ে মেরে ফেললো আখলাককে৷

মহারাষ্ট্রে লকডাউনের সময় দুই সাধু গাড়িতে করে যাচ্ছিলেন৷ তার আগেই ওই এলাকায় রটে যায়, ছেলেধরা ও চোর ঘুরছে৷ ব্যস, আর যাবে কোথায়৷ গাড়ি থামিয়ে সাধুদের চোর ভেবে মার৷ দুই সাধু ও গাড়ির চালক গণপিটুনিতে মারা গেলেন৷ পুলিশ গ্রামবাসীদের থামাতে গেলে তাদেরও পেটানো হয়৷

গণপিটুনি৷ তার হাত থেকে কারো রক্ষা নেই৷ সাধু থেকে আখলাক, সাধারণ মানুষ থেকে অতি সাধারণ মানুষ, কেউই পার পান না৷ এর সঙ্গে জড়িয়ে যায় রাজনীতি, জড়িয়ে যায় ধর্ম, জড়িয়ে যায় আধিপত্যরক্ষাকারী কোনো মানুষ বা গোষ্ঠীর স্বার্থ৷ অথবা জড়িয়ে যায় কোনো গ্রাম, জনপদ, শহরের স্বার্থীন্বেষী মানুষের কামনা৷ কারণ যাই হোক, সত্য হলো, একুশ শতকে এসেও ভারতে গণপিটুনিতে মানুষ মারা যান৷ তারপর কতজনকে ধরা হয়, কতজন শাস্তি পান সেই হিসাবও কোথাও থাকে না৷

ভারত-জুড়ে যত অপরাধ হয়, তার খতিয়ান এখন ধরা থাকে ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরোতে৷ কিন্তু সেখানে পিটিয়ে মারার কোনো খতিয়ান নেই৷ খতিয়ান থাকলেই বিপদ৷ তখন নানা প্রশ্ন উঠতে পারে৷ ভারত তো বটেই, সারা বিশ্বের প্রবণতা হলো, অস্বস্তিকর প্রশ্ন করো না৷ গত শতকে 'মারীচ সংবাদ' নামে একটি নাটক বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল৷ সেখানে ব্যবহার করা একটি গান কলকাতায় কলেজ-ইউনিভার্সিটির পড়ুয়াদের কাছে থিম সং হয়ে গিয়েছিল৷ গানটি হলো, 'কথা বলো না, কেউ শব্দ করো না, ভগবান নিদ্রা গিয়েছেন, গোলোযোগ সইতে পারেন না৷' সেই গানটিকে একটু বদলে বলা যেতেই পারে, 'কথা বলো না, কেউ প্রশ্ন করো না...৷'

গণপিটুনি নিয়ে প্রশ্ন করলেই বিপদ৷কোথায় কেঁচো খুঁড়তে কেউটে বেরিয়ে পড়ে, কে জানে৷ নিউজক্লিকের একটি নিবন্ধে যেমন লেখিকা মনীশা শেঠি প্রশ্ন করেছেন, ''কেন গণপিটুনির দায়ে অভিযুক্তদের মালা পরিয়ে অভিনন্দন জানাবেন একজন রাজনৈতিক নেতা? সেই অভিযুক্তরা জামিন পেয়েছিলেন, তখন তাদের এইভাবে বীরের সম্বর্ধনা দেয়া হয়৷'' উত্তরটা অজানা নয়৷ দেয়া হয় রাজনীতির জন্য৷ দেয়া হয়, কিছু মানুষের, জাতির বা সম্প্রদায়ের মনে আতঙ্কের স্রোত বইয়ে দিতে৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

২০১৯ সালে নিউজক্লিকের রিপোর্টে বলা হয়েছে,২০১৬ থেকে চার বছরে ছত্তিশগড়ে ১৪টি ও সারা দেশে ২৬৬টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে৷এই একটি সংখ্যাতত্ত্বই বলে দিচ্ছে, গণপিটুনি ভারতে কতটা ভাইরাল৷ কিছুদিন আগে কলকাতার রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে তো ছোট জাতের কারণে গণপিটুনির শিকার হতে হয়েছে এক কর্মীকে৷ কলকাতায় যখন এই ঘটনা ঘটতে পারে, তখন উত্তর ভারতের রাজ্যগুলিতে যে ঘটবে, তাতে আর আশ্চর্যের কী আছে৷

ক্যাপিটলে ট্রাম্প ভক্তদের তাণ্ডবের পর মনোবিজ্ঞানী গেয়ক ওয়ং সাইকলজি টুডেতে লিখেছিলেন কীভাবে মব মেন্টালিটি তৈরি করা হয়৷ সেই কারণগুলির মধ্যে অন্যতম হলো আবেগ, দায় অস্বীকার করার প্রবণতা, গ্রুপে থাকার ফলে ব্যক্তি পরিচয় গৌন হয়ে যাওয়া, গ্রুপে থাকা মানে ব্যক্তির উপর নয়, গ্রুপের উপর দায় যায় ইত্যাদি৷ ভারতের অভিজ্ঞতা বলছে, এর সঙ্গে জড়িত থাকে চাকরি না পাওয়া বা কর্মসংস্থানের নিশ্চয়তা না থাকা, জাতি ও লিঙ্গ, অভিবাসী, ধর্ম, সরকারের উপর মানুষের অনাস্থা৷

ভারতের ক্ষেত্রে তার সঙ্গে যুক্ত হবে রাজনীতি, ধর্ম, জাতপাত এবং অশিক্ষা৷ যে কারণে সহজেই হোয়াটস অ্যাপ মেসেজ দেখেই মানুষ উত্তেজিত হয়ে যায়, কোনো অগ্রপশ্চাত না ভেবে নেমে পড়ে শাস্তি দিতে৷ কাউকে গরুচোর, কাউকে শিশুচোর, কাউকে ছেলেধরা, কাউকে নিচুজাত, কাউকে রাজনৈতিক বিপক্ষ ভেবে, অথবা কোনো ধর্মীয় তাড়নায়৷

ফলে গণপিটুনিতে মানুষ মারা যান, যেতে থাকেন৷ পুলিশের খাতায় নিছক হত্যার তালিকায় সেই সংখ্যা উঠে যায়৷ সংবাদমাধ্যমে আর কটা ঘটনার কথাই বা আসে৷ ছত্তিশগড়ের মতো পিছিয়ে থাকা রাজ্যগুলির ঘটনা হলে সেসব এমনিতেই চাপা পড়ে যায়৷ গণপিটুনি চলতেই থাকে৷

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷