দমবন্ধ কলকাতার
২৪ ডিসেম্বর ২০১৮কলকাতা শহরে দূষণের মাত্রা ক্রমশই বাড়ছে৷ শীতকাল এলে, ঠান্ডা পড়লে সেই দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব আরো বেশি অনুভূত হয়৷ বাতাসে দূষণের মাত্রা বোঝা যায় ‘এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স', বা একিউআই সূচকের সাহায্যে৷ একিউআই যত বেশি হয়, দূষণের মাত্রাও তত বেশি বলে ধরে নিতে হয়৷ একিউআই শূন্য থেকে ৫০ মানে বাতাসের মান খুবই ভালো৷ ৫০ থেকে ১০০ হলে তুলনায় একটু কম ভালো৷ ১০১ থেকে ১৫০ মানে, যাঁদের শ্বাসকষ্ট বা ওই জাতীয় সমস্যা আছে, তাঁদের জন্যে খারাপ৷ ১৫১ থেকে ২০০ হলে অস্বাস্থ্যকর৷ ২০১ থেকে ৩০০ মানে অতি অস্বাস্থ্যকর৷ আর ৩০১ থেকে ৫০০-র মধ্যে একিউআই থাকলে ক্ষতিকর৷
দিল্লিতে শীতকালে এই দূষণমাত্রা থাকে ৩০০-র কাছাকাছি৷ সেটাই যথেষ্ট খারাপ৷ এই নভেম্বরের শুরুতে দিল্লির অশোক বিহার রেল স্টেশন এলাকা, যা শহরের দূষিততম অঞ্চল বলে ধরা হয়, সেখানে একিউআই ছিল ২৯২ দশমিক ২৫৷ একই সময় কলকাতার উত্তর প্রান্তে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের একিউআই ছিল ৩৮১! এমনকি কলকাতা শহরের ফুসফুস বলে পরিচিত যে অঞ্চল, গাছপালায় ঘেরা সেই ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এলাকাতেও দূষণের মাত্রা ছিল ৩১০ দশমিক ৭৫! অর্থাৎ, গাছপালা, জলাশয়— এগুলোও আর কোনো সাহায্য করছে না শহরের দূষণ কমাতে, এতটাই প্রবল তার হার৷ যে কারণে স্বাস্থ্যরক্ষার কারণে যাঁরা সকালে খোলা জায়গায়, ফাঁকা মাঠে ময়দানে হাঁটতে বেরোন, তাঁদেরও এখন নিষেধ করছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা৷ সতর্ক করে দিচ্ছেন যে, ওই ভোরবেলাতেও শহরের বাতাস শ্বাস নেওয়ার জন্য নিরাপদ নয়!
‘‘আমাদের বাতাস পরিষ্কার হওয়ার পেছনে কতগুলো জিনিস থাকে, যেমন কল-কারখানার কাছাকাছি হবে না, এবং প্রচুর পরিমাণে গাছ থাকবে, আর ধুলো-ধোঁয়া (কম থাকবে)৷ একটা ব্যাপার হচ্ছে, মেঠো ধুলো যেটা, সেটা খুব তাড়াতাড়ি পড়ে যায়৷ কিন্তু গাড়ির যে ডিজেল, বা পেট্রোল, তার ধোঁয়া যেটা থাকে, বা কল-কারখানার যে ধোঁয়া, তার সঙ্গে যে ধুলোটা মিশে থাকে, সেটা অত তাড়াতাড়ি পড়ে না৷ মাটির কিছুটা উপরে থিতিয়ে পড়ে, কিন্তু পুরোটা নিচে পড়ে না৷ (যাকে বলে) সাসপেন্ডেড পার্টিকল৷ সেইটা যখন হয়, তখন আর বলা যায় না যে, আবহাওয়া পরিষ্কার থাকবে৷'' ডয়চে ভেলেকে বললেন ফুসফুসের রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ডা. দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত৷
তাঁর বক্তব্য, কলকাতা যেহেতু খুব পরিকল্পিত নগরী নয়, জনবসতির আশেপাশেই কল-কারখানা গড়ে উঠেছে৷ মূলত ক্ষুদ্র শিল্প৷ কিন্তু তার থেকেও বিভিন্নভাবে দূষণ ছড়াচ্ছে৷ আরো একটা সমস্যা, যানবাহন প্রচুর বেড়ে গেছে৷ এবং সেক্ষেত্রে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই যে, সারাদিনে কতগুলো গাড়ি বেরোবে, বা বেরোবে না৷
তৃতীয় সমস্যা হলো অটো, বা টোটোর ক্ষেত্রে কাটা তেলের ব্যবহার, যা সস্তার বিকল্প জ্বালানি হলেও ভয়ঙ্কর তার দূষণক্ষমতা৷ এগুলোর থেকে যে বিভিন্ন ধরনের ক্ষতিকর গ্যাস বেরোচ্ছে, তা বাতাসকে দূষিত করে রাখছে৷ এর পাশাপাশি কল-কারখানা থেকে যে ধোঁয়া বেরোচ্ছে, তার মধ্যে শিসার মতো একাধিক দূষণ-উপাদান থাকে৷ এগুলো সবই বাতাসে মিশে যাচ্ছে৷ এবার এই দূষিত বাতাস যেহেতু মাটির কাছাকাছি একটা ধোঁয়াশার মতো ভেসে থাকছে, যারা রাস্তায় চলাফেরা করছেন, বা একতলা বাড়িতে থাকছেন, তাঁরা সবথেকে বেশি দূষণের শিকার৷ এবং এই দূষিত বাতাসের ঘনত্ব সকালের দিকে বেশি থাকে৷ বেলা বাড়লে সূর্যের আলো এসে পড়ে, বাতাসের তাপমাত্রা বাড়ে, তখন ধোঁয়াশা কিছুটা হালকা হয়৷ ক্ষতিকর সাসপেন্ডেড পার্টিকল আরো কিছুটা থিতিয়ে পড়ে, বাতাসের সঞ্চালন বাড়ে, ফলে ক্ষতির সম্ভাবনাও কিছুটা কম হয়৷
এ ক্ষেত্রে কী করার আছে? ডা. দাশগুপ্ত বলছেন, যে কোনো সমস্যার তিন ধরনের সমাধান আছে৷ প্রতিরোধক, স্থায়ী, এবং অস্থায়ী৷ যেটা মানুষ চটজলদি করতে পারেন, সেই অস্থায়ী সমাধান হলো, ভোরবেলার দিকে, খুব দরকারি কোনো কাজ না থাকলে, শীতকালে বাইরে না বেরোনোই ভালো৷ যতটা কম দূষণের আওতার বাইরে থাকা যায়৷ যদি বেরোতেই হয়, তা হলে নাক-মুখ ঢাকা মুখোশ পরে থাকা উচিত৷ এবার স্থায়ী সমাধান করতে হলে বড় আকারে করতে হবে৷ নিজেদের এলাকায় ছোট-বড় কী কল-কারখানা আছে, সেটা দেখা, তারা কোনটা কতটা দূষণ ছড়ায়, সেটা মাপা৷ নতুন গাছ পোঁতা, পুরনো গাছ কেটে না ফেলা৷ এগুলো স্থায়ী সমাধান৷
তবে, ডা. দাশগুপ্তর মতে, সেরা সমাধান হলো আগাম প্রতিরোধ৷ দূষণ হতে পারে এমন কিছু করতেই না দেওয়া, যাতে দূষণের সুযোগই না থাকে৷ ‘কিন্তু এ ধরনের কিছু করা আমাদের দেশে মুশকিল৷ যেটা করা যায়, স্থায়ী বা অস্থায়ী সমাধানের ভারসাম্য যদি করা যায় এখানে৷'' বলছেন ডা. দাশগুপ্ত৷
কিন্তু সমস্যা হলো, সেটাও কি আদৌ সম্ভব? পরিসংখ্যান বলছে, কলকাতা, তথা পশ্চিমবঙ্গে ৯৯ শতাংশ মালবাহী গাড়ি এবং যাত্রীবাহী বাস ডিজেলে চলে৷ বাকি বড় শহরে যে দূষণ সৃষ্টিকারী জ্বালানির ব্যবহার ক্রমশই সঙ্কুচিত হচ্ছে৷ এ ছাড়া, নির্বিচারে গাছ কেটে ফেলা, জলাশয় বুজিয়ে দেওয়ার মতো পরিবেশ ধ্বংস করা ঘটনা তো ঘটছেই নজরের আড়ালে৷ প্রশাসনও এ ব্যাপারে সতর্ক নয়৷ দিল্লি শহরে যেখানে দূষণ মাপার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র আছে ১৯টি, কলকাতায় সেখানে এমন যন্ত্রের সংখ্যা মাত্র দুটি!