1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বছরের শেষে সন্দেশখালিতে মমতা

পায়েল সামন্ত পশ্চিমবঙ্গ
৩১ ডিসেম্বর ২০২৪

সন্দেশখালিতে নারী নির্যাতনের অভিযোগে রাজ্য রাজনীতি সরগরম হয়েছিল চলতি বছরে। ২০২৪ সালের একেবারে শেষে সেখানে সভা করলেন মুখ্যমন্ত্রী।

https://p.dw.com/p/4ohZQ
সন্দেশখালির নির্যাতিতারা
সন্দেশখালিতে নির্যাতনের অভিযোগছবি: Subrata Goswami/DW

তৃণমূল নেতা শাহজাহান শেখ ও তার দলবলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ উঠেছিল উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালিতে। জমি দখল থেকে নারী নিগ্রহের নানা অভিযোগে উত্তাল হয়ে উঠেছিল রাজনীতি।

উত্তাল সন্দেশখালি

এই বছরের একদম গোড়ায় সংবাদ শিরোনামে উঠে আসে সন্দেশখালি। রেশন দুর্নীতির তদন্তে শাহজাহানের বাড়িতে অভিযান চালিয়েছিল কেন্দ্রীয় সংস্থা। পাঁচ জানুয়ারি ইডির আধিকারিকরা জওয়ানদের সঙ্গে নিয়ে সেখানে যান। অভূতপূর্ব পরিস্থিতি তৈরি হয়। তৃণমূল নেতার অনুগামীরা চড়াও হন কেন্দ্রীয় সংস্থার আধিকারিকদের উপর। আক্রান্ত হন জওয়ানরাও।

এরপর খুলে যায় প্যান্ডোরার বাক্স। একের পর এক অভিযোগ উঠে আসতে থাকে শাহজাহানের বিরুদ্ধে। মূল অভিযুক্ত হিসেবে তার দুই সঙ্গী উত্তম সর্দার ও শিবু হাজরার নামও উঠে আসে। সঙ্গীরা পুলিশের জালে পড়লেও অনেকদিন খুঁজে পাওয়া যায়নি শাহজাহানকে। এ নিয়ে বিতর্ক হয়। অবশেষে ২৯ ফেব্রুয়ারি শাহজাহান শেখকে পাকড়াও করে রাজ্য পুলিশ। তাকে তুলে দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় সংস্থার হাতে।

সন্দেশখালির প্রতিবাদী নারী এখন গোপন ডেরায়

লোকসভা নির্বাচনের মুখে সন্দেশখালি রাজ্য রাজনীতির বড় আলোচ্য বিষয় হয়ে ওঠে। শুধু নারী নির্যাতন নয়, জমি গ্রাস, নদী বুজিয়ে বাজার তৈরি, সরকারি প্রকল্পের বিনিময়ে টাকা আত্মসাৎ -- এমন নানা কুকর্মের অভিযোগ উঠতে থাকে শাহজাহান ও তার বাহিনীর বিরুদ্ধে। নানা অভিযোগে অভিযুক্ত তৃণমূল নেতা এখনো জেলবন্দী। তিনি বারবার নিজেকে নির্দোষ বলে দাবি করেছেন।

অভিযোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর ছিল নারী নিগ্রহের বিষয়টি। সন্দেশখালীর বাসিন্দা বিভিন্ন গ্রামের নারীরা এগিয়ে এসে বলেছিলেন তাদের উপর কিভাবে অত্যাচার চালিয়েছে শাহজাহানের বাহিনী। বিভিন্ন সময় তাদের দলীয় কার্যালয়ে ডেকে পাঠানো হতো। এমনকি ধর্ষণের অভিযোগও তোলা হয়েছে। পাঁচজন তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে এই মর্মে এফআইআর দায়ের করা হয় সন্দেশখালি থানায়।

নির্বাচনের ফলাফল

সন্দেশখালি উত্তেজনা দিয়ে থাকার মধ্যেই চলে আসে লোকসভা নির্বাচন। উত্তর ২৪ পরগনার বসিরহাট লোকসভা কেন্দ্রের মধ্যে পড়ে সন্দেশখালি বিধানসভা। সংখ্যালঘু গরিষ্ঠ বসিরহাট কেন্দ্রে তৃণমূলের অ্যাডভান্টেজ ছিলই। এতে সন্দেশখালি ইস্যু কোন প্রভাব ফেলতে পারে কিনা সেদিকে নজর ছিল সকলের। বিজেপি প্রার্থী করেছিল সন্দেশখালি আন্দোলনের অন্যতম মুখ রেখা পাত্রকে। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ফোন করেছিলেন তাকে।

কিন্তু বিপুল ভোটে বসিরহাটের তৃণমূল প্রার্থী অধুনা প্রয়াত হাজী নুরুল ইসলাম জয়ী হন। একমাত্র সন্দেশখালি বিধানসভায় বিজেপি প্রার্থী রেখা পাত্র লিড নিয়েছিলেন। ৮০০০ ভোটে তিনি এগিয়েছিলেন তৃণমূল প্রার্থীর থেকে। কিন্তু বাকি ছ'টি বিধানসভা কেন্দ্রে সহজেই জয়ী হয় ঘাসফুল প্রার্থী।

সন্দেশখালির নারীরা অভিযোগ তুলেছিলেন, মাঝরাতে তাদের পিঠে তৈরির জন্য ডেকেছিলেন উত্তম, শিবুরা। সোমবার সন্দেশখালিতে মুখ্যমন্ত্রী এ সব অভিযোগ নিয়ে সরাসরি কিছু বলেননি। তার ইঙ্গিতপূর্ণ মন্তব্য, "পিঠে পার্বণ হবে। নবান্নও হবে। সবাই মিলেমিশে থাকবেন। কোনও দুষ্টু লোকের খপ্পরে পড়বেন না। মেয়েরা মনে রাখবেন, কেউ ডাকল আর চলে গেলেন, সেটা যাবেন না। কোনও সরকারি প্রকল্পের যখন সুবিধা পাওয়ার চেষ্টা করবেন, তখন দুয়ারে সরকারে গিয়ে বলবেন।"

অতীত ভুলে এগনোর বার্তা দিয়েছেন মমতা। তার ভাষায়, "আমি চাই, যা হয়েছে হয়েছে, আমার মনে নেই, আমি ভুলে গিয়েছি। আমি চাই, সন্দেশখালির মেয়েরা–ছেলেরা ভারতে এক নম্বর স্থানে আসুক। তারা সারা বিশ্ব জয় করুক। তারা এগিয়ে চলুক।"

বিরোধীদের উদ্দেশে কটাক্ষ ছিল মুখ্যমন্ত্রীর বক্তব্যে। তার বক্তব্য, "কেউ যদি ভুল বোঝায়, মিথ্যা কথা বলে... আমি জানি, এখানে অনেক টাকার অঙ্কের খেলা হয়েছে। পরে দেখলেন তো সব ভাঁওতা! মিথ্যা বেশি দিন চলে না। একদিন প্রকাশ পায়ই।"

সাংবাদিক সুমন ভট্টাচার্য ডিডাব্লিউকে বলেন, "মহিলা ভোটকে নিজেদের কবজায় আনার জন্য বিজেপি সন্দেশখালি ইস্যু ব্যবহার করেছিল। এখানে যতটা হয়েছিল, তার চেয়ে অনেক বেশি প্রচার করা হয়েছে। তৃণমূল ধীরে ধীরে রাজনৈতিকভাবে তার মোকাবিলা করেছে।  প্রশাসনিকভাবে সন্দেশখালিতে যখন জমি দখলের অভিযোগ উঠেছিল, তখন সরকারি তরফে ক্যাম্প করে সেই অভিযোগগুলি নেয়া হয়েছিল, জমি ফেরত দেয়া হচ্ছিল। আমার মনে হয় সন্দেশখালি বেশি হইচই করার বিষয় নয়, ২০২৪-এর লোকসভা ভোটের ফলাফল সেটা দেখিয়ে দিয়েছে।"

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী সহ বিভিন্ন প্রকল্পের সুবিধা বিতরণ করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। সুমন বলেন, "মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনৈতিক কৌশল হচ্ছে মহিলা ভোটকে ধরে রাখা। যার জন্য তিনি সন্দেশখালি থেকে নটী বিনোদিনী থিয়েটারের কথা বলেছেন। শহুরে মহিলাদের জন্য এটা যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বার্তা, পাশাপাশি প্রান্তিক মহিলাদেরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বোঝানোর চেষ্টা করলেন যে, আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।"

নির্বাচনী ফলকে অভিযোগের নিষ্পত্তি হিসেবে দেখতে রাজি নন অনেকেই। প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডিডাব্লিউকে বলেন, "ন্যায় অন্যায়ের মাপকাঠি ভুল ভাবে তৈরি হয়েছে ভোট দিয়ে। যিনি ভোটে জিতলেন তার বিরুদ্ধে সব অভিযোগ যেন মিথ্যা প্রমাণ হয়ে গেল। সন্দেশখালিতে গিয়ে মমতা যাই বলুন না কেন, সেই অভিযোগগুলো তো আর মিথ্যে হয়ে যায় না। হয়তো কিছু বাড়তি ছিল, কিন্তু তৃণমূলও অনেক অভিযোগ স্বীকার করেছিল।"

রাজনৈতিক বিশ্লেষক রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী ডিডাব্লিউকে বলেন, "মুখ্যমন্ত্রী গতকাল বলেছেন দুষ্টু লোক থেকে সাবধান। উনি বিরোধীদের কাউকে দুষ্ট লোক ভাবলে নামটা বলে দিতেন। অর্থাৎ বুঝিয়ে দিলেন যে মোগল সম্রাট (শাহজাহান) ভালো নন। দুষ্টের দমন করাই শাসকের কাজ। মুখ্যমন্ত্রী দুষ্টুদের দমন করতে চাইছেন না। বরং মানুষ সাবধানে থাকুন, সেটা উনি বলতে চাইছেন।"

সংবাদ মাধ্যমের দিকেও আঙুল উঠছে। শুভাশিস বলেন, "বিভিন্ন ঘটনার প্রভাবে পুরনো ঘটনা চাপা পড়ে যায়। মিডিয়ারই দায়িত্ব সেগুলো তুলে ধরা। মিডিয়া কাজটা সবসময়ে ঠিকঠাক করে না। ফলে একটা ধারণা তৈরি হয়ে যায় যে নির্বাচন এবং উপনির্বাচনে কয়েক লক্ষ ভোটে জেতার পর বাকি যে অভিযোগ ছিল সেগুলি সবই মূল্যহীন হয়ে গিয়েছে। মানুষের অভিযোগ থেকে যায়, কিন্তু সেগুলি আর সামনে আসে না। সন্দেশখালি সেরকমই একটা পর্যায়।"

মুখ্যমন্ত্রী দুষ্টুদের দমন করতে চাইছেন না বরং মানুষ সাবধানে থাকুন, বলতে চাইছেন: রাজাগোপাল ধর চক্রবর্তী

লোকসভা নির্বাচনে সন্দেশখালিকে ব্যবহার করে বৃহত্তর ছক কষেছিল বিজেপি। এমনটাই বোঝাতে চেয়েছেন সুমন ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, "সন্দেশখালিতে যে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের চেষ্টা ছিল, সেটা থেকে বেরিয়ে আদিবাসী ভোটকে তৃণমূল নিজেদের দিকে টেনেছে। ২০২৪-এর লোকসভা ভোটেই আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। তা না হলে বাঁকুড়া বা ঝাড়গ্রামের মতো আসন বিজেপির হাত থেকে তৃণমূল নিতে পারত না। এর ফলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একদিক থেকে রাজনৈতিকভাবে এগিয়েছেন।"

রাজা গোপাল বলেন, "বসিরহাটে তৃণমূল জিতলেও সন্দেশখালিতে রাজ্যের শাসক দল হেরে গিয়েছে। ফলে মানুষ যে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে, সেটা স্পষ্ট।"

রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন সেই সময় সন্দেশখালি গিয়ে অভিযোগকারী নারীদের পাশে দাঁড়ালেন না, সেই প্রশ্ন অনেকে তুলছেন।

রাজাগোপালের বক্তব্য, "বছরের শুরুতে ঘটনাটা ঘটেছিল, নারীরা নিরাপত্তাহীন হয়েছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী সে সময় যাওয়ার কথা ভাবেননি। উনি বলেছিলেন জিতলে যাব। জেতার পরেও ওকে দেখা যায়নি। বছরের শেষে বোঝা গিয়েছে, সেখানে বিরোধীরা খুব একটা শক্তিশালী হতে পারেনি। এখন মুখ্যমন্ত্রী ভাবছেন, সন্দেশখালি তার জন্য অনেকটাই নিরাপদ। সন্দেশখালি থেকে নতুন কোনও প্রতিবাদ আর উঠবে না। নারীদের উপর যে অত্যাচার ও লাঞ্ছনা হল, তার কোনো বিহিত হল বলে মনে হয় না। এখানে যদি একটা দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হতো, তাহলে অন্য জায়গায় এ রকম হওয়ার আশঙ্কা কম থাকতো।"

ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি পায়েল সামন্ত৷
পায়েল সামন্ত ডয়চে ভেলের কলকাতা প্রতিনিধি৷