বাঙালির নোবেল প্রাপ্তি কি হাতুড়েদের স্বীকৃতি?
২৪ অক্টোবর ২০১৯ভারতের মতো উন্নতিশীল দেশে চিকিৎসক ও রোগীর অনুপাতে বিস্তর ফারাক রয়েছে৷ পর্যাপ্ত সংখ্যায় চিকিৎসক নেই, গ্রামের ক্ষেত্রে ছবিটা আরো খারাপ৷ এর ফলে সমান্তরাল একটি চিকিৎসা পরিষেবা গড়ে উঠেছে৷ হোমিওপ্যাথ, আয়ুর্বেদের সঙ্গে হাতুড়ে ডাক্তারদের পসার রয়েছে গ্রামাঞ্চলে৷ হাতের কাছে সরকার-স্বীকৃত চিকিৎসক না থাকলে কোয়াকদের কাছে ছুটে যায় মানুষ৷ তাঁরাই ছোটখাটো সমস্যায় রোগীদের ওষুধ দেন৷
চিকিৎসকদের সংগঠন লিভার ফাউন্ডেশন এর সঙ্গে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় পশ্চিমবঙ্গের গ্রামাঞ্চলে কাজ করেছেন৷ ২০০৭ সাল থেকে বীরভূমে এই প্রশিক্ষণের পর্ব শুরু হয়৷ এই বিষয়ে অভিজিৎ বলেছেন,‘‘গ্রামীণ এলাকার সিংহভাগ মানুষ এই স্বাস্থ্য পরিষেবকদের ওপর নির্ভর করে থাকেন৷ এঁদের দূরে সরিয়ে রাখলে সমস্যা হবে দরিদ্র মানুষের৷ তার বদলে এঁদের প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজের উপোযোগী করে গড়ে নেওয়া ভালো৷''
অভিজিতের নোবেল প্রাপ্তির পর মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, অভিজিৎ রাজ্য সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন৷ তারা চান, প্রাথমিক চিকিৎসাটুকু সামলে দিন কোয়াক ডাক্তাররা৷ ওরা চিকিৎসা পরিষেবায় সহযোগী হিসেবেই কাজ করবেন৷ ওঁদের ডাক্তারের স্বীকৃতি দেওয়া হবে না৷ রাজ্যের মুখ্যসচিব রাজীব সিনহা জানান, যে কাজের জন্য তিনি নোবেল পেয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম কোয়াকদের ক্ষমতায়ন৷ বীরভূমে তিনি যখন একাজ শুরু করেন, তখন রাজ্য সরকার তার সঙ্গে যুক্ত ছিল৷ সেই প্রশিক্ষণ এখনও চলছে৷ ছ'মাসের এই প্রশিক্ষণ এখনও পর্যন্ত পেয়েছেন ১ লক্ষ ১০ হাজার স্বাস্থ্য পরিষেবক৷
অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে এই প্রকল্পে কাজ করেছেন বীরভূমের দুবরাজপুরের স্বাস্থ্য পরিষেবক শুভাশিস চট্টরাজ৷ তিনি দীর্ঘদিন ধরে গ্রামাঞ্চলে স্বাস্থ্য পরিষেবার সঙ্গে যুক্ত৷ তিনি বলেন, ‘‘নোবেলজয়ীর সঙ্গে আমরা কাজ করার সুযোগ পেয়েছি৷ তিনি এই জেলার অনেক জায়গায় আমাদের কাজ পর্যবেক্ষণ করেছেন৷ এটা ভেবে খুব ভাল লাগছে৷'' কী ভূমিকা পালন করেন শুভাশিসেরা? তিনি বলেন, ‘‘আমরা রোগীর প্রাথমিক সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করি৷ জরুরি পরিস্থিতিতে পরিষেবা দিই৷ রোগীর সমস্যা গুরুতর বুঝলে চিকিৎসকদের পরামর্শ নিতে বলি৷ আমরা কখনোই নিজেদের ডাক্তার বলতে পারি না৷ প্রেসক্রিপশনও লেখার কথা নয়৷'' তিনি জানান, মূলত বেসরকারি উদ্যোগেই গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের প্রশিক্ষণের কাজ চলছে৷ একবার প্রশিক্ষণ হওয়ার পর লিভার ফাউন্ডেশন নিয়মিত আলোচনা সভার আয়োজন করে৷ সেখানে অংশ নেন স্বাস্থ্য পরিষেবকেরা৷
ডাক্তার অভিজিৎ চৌধুরীর নেতৃত্বে লিভাব ফাউন্ডেশনের প্রকল্পে সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে ‘দি ওয়ার্ল্ড ব্যাংকস নলেজ ফর চেঞ্জ প্রোগ্রাম', ‘ব্রিস্টাল মায়ারস স্কুইব ফাউন্ডেশন'৷ রাজ্যের প্রথম সারির চিকিৎসকদের একাংশ এই উদ্যোগের পক্ষে রয়েছেন৷ কলকাতার চিকিৎসক সন্দীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘আমাদের দেশে এটাই পথ৷ প্রশান্ত শূর যখন স্বাস্থ্যমন্ত্রী ছিলেন, তখন রাজ্য সরকার সিএইচএসও নামে একটি প্রকল্প চালু করেছেন৷ গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল৷ এদের ‘খালি পায়ে ডাক্তার' বলা হত৷ আমি তাঁদের সঙ্গে কাজ করেছি৷ এঁরা খুব ভাল কাজ করেছিলেন৷ যদিও বছর তিনেক পর এটা বন্ধ হয়ে যায়৷''
যদিও চিকিৎসকদের সবচেয়ে সংগঠন ডক্টরস ফোরাম গোড়া থেকেই এ ধরনের উদ্যোগের বিরোধিতা করছে৷ সংগঠনের সম্পাদক কৌশিক চাকী বলেন, ‘‘কোয়াকদের প্রশিক্ষণের সঙ্গে নোবেলজয়ীর যোগ কতটা জানি না৷ তবে গরিবের চিকিৎসা হাতুড়েদের দিয়ে হবে, এই ভাবনার সঙ্গে আমরা একমত নই৷ কোয়াকরা ভুল করলে রোগী ক্ষতিপূরণ পাবে কী করে?'' কলকাতার চিকিৎসক কৌশিক দাসের বক্তব্য, ‘‘সহযোগী পর্যন্ত ঠিক আছে, সেমি-ডাক্তার হিসেবে তৈরি করলে আপত্তি আছে৷ এতদিন চিকিৎসা করার পর রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে আমাদেরও দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকে, কোয়াকদের ক্ষেত্রে কী হবে? এ দেশে ফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানির যে প্রতিপত্তি, তা আরও বাড়বে কোয়াকদের হাত ধরে৷'' ফোরামের যুক্তি খারিজ করে সন্দীপ ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ডাক্তাররা গ্রামে যেতে চান না৷ আর্থিক কারণে শহরমুখী প্রবণতা রয়েছে৷ এটা বদলানোর আশু সম্ভাবনা নেই৷ তাই গ্রামীণ স্বাস্থ্য পরিষেবকদের ব্যবহার করাই সঠিক পথ৷''