মাছ ভজন
১৩ আগস্ট ২০১৮তখন আমাদের নিবাস বরগুনায়৷ আমতলীতে৷ প্রকৌশলী পিতার চাকরির সূত্রে৷ আকারে ও প্রকারে আমি তখন এতটাই ক্ষুদ্র যে, খণ্ড খণ্ড কতক স্মৃতি ছাড়া আর সব কিছুই বিস্মৃত হয়েছি৷ তবে মানসপটে যেসব দৃশ্যের আনাগোনা, তার একটি মাছ ধরার৷ আহা! যেন এক উৎসব৷
যে সরকারি বাড়িটাকে নিজের বাড়ি ভাবতাম, তার সামনেই একটা পুকুর৷ ছিল বাঁধানো ঘাট৷ পুকুরের দৈর্ঘ্য প্রস্থের মাপ জিজ্ঞেস করলে বিব্রত হব৷ তবে মনের গহীন থেকে ভেসে ওঠা বাইনারি কোড বলছে, মাঝে মাঝেই সেখান থেকে মাছ ধরা হত৷ জাল দিয়ে অনেকে মিলে মাছ ধরতেন৷ হৈ চৈ পড়ে যেত৷
অনেকটা রূপকথার মতো মনে হতে পারে এখন, ঐ স্বল্প-গভীর জলের মাছগুলো আমার চেয়েও দীর্ঘ ছিল! তাই যে পাশে মাছগুলো ধরা হতো, আমি থাকতাম তার থেকে দূরে৷ আর আজকাল বাজারে যেসব ‘বড়' মাছ পাওয়া যায়, সেগুলো তখন ধরা পড়লে ছেড়ে দেয়া হতো, যথেষ্ট বড় নয় বলে!
কী আর করা৷ জীবন যেখানে যেমন!
এখানেই শেষ নয়৷ আরো মজার ঘটনা আছে৷ বাড়ির কাছেই একটা ক্ষেতমতো জায়গায় চিংড়ি মাছ চলে আসত৷ নদীর বড় বড় চিংড়ি৷ কীভাবে আসত কে জানে! যতটুকু বুঝতে পারি, নদীর পানির সঙ্গে চলে আসত৷ এসে আটকে যেত৷ পানি নেমে গেলেও চিংড়িকূলের বিদগ্ধ প্রতিনিধিদের ঘরে ফেরা হতো না৷
যত মাছের গল্প করছি, এই সকল মৎস্যকূল আমার উদরে জায়গা পেত না৷ অন্যমস্তিষ্ক রসনাতৃপ্ত করে অন্যের কণ্ঠ দিয়ে চালান হতো৷
কারণ আমি তখন মাছ খেতাম না! অবাক হবার কিছু নেই৷ সত্যি খেতাম না৷ আরো অবাক হবার কিছু নেই, কারণ আমার বাড়ির কেউ মাছ খেতেন না!
এলাকার বড়কর্তা হিসেবে সমস্ত ভোগে পিতৃমহোদয়ের অগ্রাধিকার থাকলেও তা দুর্ভোগের কারণ হতো মাতৃমহোদয়ের৷ তিনি ও তাঁর কর্মসহযোগীরা মিলে সেই মৎস্যসম্প্রদায়কে কেঁটেকুটে অন্যকে উপঢৌকন পাঠাতেন৷ কিংবা বাড়িতে রান্না হলেও তা হতো অপরের প্রয়োজনে৷
ছোটবেলায় পড়েছিলাম, দ্য কাউ লিভস অন গ্রাস৷ আর আমরা? উই লিভড অন কাউ অর চিকেন৷
এখন? বাড়ির লোকেরা সেইসব স্মৃতি হাতড়ে যেন মরমে মরে যান৷ কী ভীষণ আফসোস!
মাছের প্রতি আমার আগ্রহ জন্মেছে আরেকটু পরে৷ তা-ও বড় মাছগুলোই খেতে মজা, এই গুঢ় তত্ত্বের ওপর ভর করে৷ এই তত্ত্বে বিশ্বাস ছিল বহুকাল৷ যখন বরগুনার পাঠ চুকিয়ে তল্পিতল্পা গুটিয়ে কুমিল্লায় পাড়ি দিলাম, তখন বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে কত হাঁকিয়ে হেঁকে গেছেন ‘কাচকি কাচকি' করে৷ আমাদের টলাতে পারেননি৷
এমনকি কালের বিবর্তনে টাকি-টেংরারা কখনো সখনো টেবিল অবধি আসতে পারলেও, আমি চোখ ফিরিয়ে নিয়েছি৷ মুখও৷ আর কৈ মাছও আমাকে টানতে পারলো কই? পেরেছে, আরো পড়ে৷
স্কুল পেরিয়ে কলেজ৷ সুবাদে রাজধানীকে চেনা৷ কত লোক, কত রং৷ কত ব্যস্ততা৷ মলা-ঢেলাদের সঙ্গে প্রথম ভাব জমিয়েছি এখানেই৷ এরপর বিশ্ববিদ্যালয়ের সময়টায় মাছ ভর্তায় মজেছি৷ বন্ধুদের সঙ্গে চলে গিয়েছি চিরল চিরল বাতাস বয় যেখানে, সেই বিরিশিরি৷
ওখানে আলুভর্তা স্পেশালিস্ট এক রাঁধুনি খাওয়ালেন বাঁশপাতা মাছ৷ আহা কী স্বাদ!
পেশাগত প্রয়োজনে ছুটে বেড়িয়েছি, দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত৷ শোল, পিউলি, বাটা, শিং, মাগুর, তপসে, পাবদা, খলসে, কাচকি, পাইশা, সরপুটিরা আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খেয়েছে৷ আমিও খেয়েছি তাদের৷
একবার রাজশাহীতে এক অনুজ খাওয়ালেন পদ্মার পাঁচমিশালী মাছ৷ নাম জানি না৷ নানান রকমের ছোট মাছের মিশ্রণ৷ খুব ভোরে ঘাটে পাওয়া যায় মাছগুলো৷ উঠে আসে অন্য মাছের সঙ্গে৷ ঝোল করে রান্না হলো৷ মুখে দিলেই গলে যায়৷ জিহ্বা থেকে পাকস্থলী পর্যন্ত স্বাদ টের পাওয়া যায়৷
সাতসমুদ্র তের নদী পেরিয়ে বন শহরেও খুঁজে পেয়েছি এক ঠিকানা৷ যেখানে গেলে মেলে দেশি মাছ৷ সেসব মাছেরা জল ছেড়ে বরফে ঢেকে এ পর্যন্ত আসতে মাস পেরিয়ে যায়৷ তাতে কি? দেশি মাছ তো৷
দেশে বিদেশে কত জায়গায় কত মাছ খেয়েছি৷ কিন্তু মিঠা পানিতে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে ওঠা মাছের স্বাদ আর কোথায়? নেই৷ চাষের মাছে আঁশ কি মেটে?
যুবায়ের আহমেদের লেখা এই ব্লগ পোস্টটি কেমন লাগলো আপনাদের? লিখুন আমাদের, নীচের ঘরে৷