জার্মানিতে ড্রোন বিতর্ক
৩ জুন ২০১৩ড্রোন হামলার অনেক সুবিধা আছে: আক্রমণকারী নিজেকে পুরোপুরি নিরাপদ স্থানে রেখেই আক্রমণ পরিচালনা করতে পারেন৷ মনুষ্যবিহীন ড্রোন বিমানগুলো নিয়ন্ত্রণ করা হয় অনেক দূরে বসে৷ ফলে শত্রুপক্ষ আর আক্রমণকারী সৈনিকের দূরত্ব হয় কয়েক হাজার কিলোমিটার৷ ১১ সেপ্টেম্বর পরবর্তী সময়ে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে আফগানিস্তান এবং অন্যান্য অঞ্চলে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধে গুরুত্বপুর্ণ ভূমিকা রাখছে এই ড্রোন৷ তবে এসবের ব্যবহার নৈতিক এবং আইনি দিক থেকে বিতর্কিত৷
জার্মান টেলিভিশন অনুষ্ঠান ‘পানোরমা' এবং দৈনিক পত্রিকা ‘স্যুডডয়চে সাইটুং' এ প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী, মার্কিন বাহিনী হামলা এবং পূর্বপরিকল্পতি হত্যাকাণ্ড পরিচালনায় তাদের জার্মান ঘাঁটিগুলো ব্যবহার করছে৷ বিশেষ করে স্টুটগার্টে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আফ্রিকা কম্যান্ড (আফ্রিকম) এবং রামস্টাইনে অবস্থিত মার্কিন বিমান ঘাঁটি ড্রোন হামলা পরিচালনায় বিশেষ ভূমিকা রাখছে৷
আফ্রিকম আফ্রিকায় সব ধরনের মার্কিন মিশন জার্মানিতে বসে নিয়ন্ত্রণ করে৷ এই বিষয়টি মাথায় রেখে, জার্মান গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন দাবি করছে, এটা ধারণা করা নিরাপদ যে, আফ্রিকায় ড্রোনের ব্যবহারও সমন্বয় করা হয় এখান থেকে৷ বিশেষ করে সোমালিয়ায় সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের হত্যায় ড্রোন ব্যবহার করা হয়েছে৷ লন্ডনভিত্তিক ‘ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিজম' এর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সাল থেকে এখন অবধি সোমালিয়ায় ড্রোন হামলায় প্রাণ হারিয়েছে ২৭ জনের বেশি মানুষ, যাদের মধ্যে নিরীহ কয়েকজন রয়েছেন৷
রামস্টাইন কি গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি?
আফ্রিকায় অবস্থানরত ড্রোনগুলোর সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত নিয়ন্ত্রক সেনাদের যোগাযোগ মূলত রামস্টাইনে অবস্থিত স্যাটেলাইট স্থাপনার উপর নির্ভরশীল৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত মার্কিন বিমান বাহিনীর নথি অনুযায়ী, এই স্থাপনার সহায়তা ছাড়া আফ্রিকায় ড্রোন হামলা পরিচালনা সম্ভব নয়৷ কেন্দ্রীয় আকাশ এবং মহাকাশ অপারেশন সেন্টার বা এওসি'র অবস্থানও রামস্টাইনে৷
মার্কিন ড্রোনগুলো অবশ্য জার্মানিতে অবস্থান করছে না৷ আফ্রিকা মিশনের জন্য এসব ড্রোনের অবস্থান জিবুতি, নাইজার, ইথিওপিয়া এবং সেশেলস৷ তবে এসব ড্রোন নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রয়োজনীয় প্রযুক্তি এবং ব্যক্তির অবস্থান জার্মানিতে বলেই দাবি গণমাধ্যমের৷
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইউরোপিয়ান কমান্ডের মুখপাত্র মেজর রায়ান ডোনাল্ড ডয়চে ভেলের এক প্রশ্নের উত্তরে জানিয়েছেন, এওসি উড়ালের তত্ত্বাবধানে থাকে, কিন্তু কোন বায়ুবাহিত বস্তু সরাসরি পরিচালনা করে না৷
আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন
অধিকাংশ বিশেষজ্ঞই মনে করেন, সোমালিয়াসহ যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে ড্রোনের ব্যবহার আন্তর্জাতিক আইনে গ্রহণযোগ্য নয়৷ পানোরমার প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক আইন অ্যাক্টিভিস্ট টিলো মারাউন বলেছেন, যুদ্ধক্ষেত্রের বাইরে ড্রোন হামলার মাধ্যমে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীকে হত্যার বিষয়ে জার্মান সরকার জেনেও প্রতিবাদ না করে থাকলে সেটি আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হতে পারে৷
জার্মানির বিরোধী দল সরকারের কাছে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা চেয়েছে৷ বাম দলের সংসদীয় প্রতিরক্ষা কমিটির সদস্য পাউল শেফার এই বিষয়ে বলেন, ‘‘জার্মান সরকারকে এই বিষয়টির সুরাহা করতে হবে৷ অন্যথায় জার্মান সরকার আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের অংশ হওয়ার যে সন্দেহ তৈরি হয়েছে, তা থেকে যাবে৷ ফলে বিষয়টি এভাবে ফেলে রাখা যায়না৷''
সেনা সংবিধির দিকেও তাকাতে হবে
অবশ্য জার্মানিতে মার্কিন সেনাদের উপস্থিতি এবং তাদের কর্মকাণ্ড বিষয়ে এই মুহূর্তে খুব বেশি কিছু করাও সম্ভবত সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়৷ কেননা, একটি সংবিধি অনুযায়ী মার্কিন সেনারা এই দেশে অবস্থান করছে৷ শেফার বলেন, ‘‘সেনা সংবিধি নিয়ে আমাদের নতুন করে সমঝোতা প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে৷ আমি আশঙ্কা করছি, বর্তমানে এই বিষয়ে (ড্রোন) জার্মানির হস্তক্ষেপের ক্ষমতা সীমিত৷ আইনে দিক থেকে আমাদের ঘাটতি রয়েছে৷''
জার্মান সরকারের মুখপাত্র স্টেফেন সাইবার্ট মার্কিন কর্মকর্তাদের সঙ্গে এক সংলাপের বরাতে বার্লিনে জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কোন আলামত তারা পাননি৷
‘‘জার্মান সরকারের পক্ষ থেকে আমি গণমাধ্যমের দাবি নিশ্চিত করতে পারছি না'', বলেন সাইবার্ট৷
লঙ্ঘন দেখছেন না কেরি
সম্প্রতি ওয়াশিংটনে জার্মান পররাষ্ট্রমন্ত্রী গিডো ভেস্টারভেলের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ও গণমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনের বিষয়ে বিস্তারিত মন্তব্য করতে রাজি হননি মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি৷ তিনি বলেন, ‘‘আমি অপারশেনের বিষয়ে বিস্তারিত এখানে জানাতে চাই না৷ আমাদের কর্মকাণ্ড বৈধ৷ আমরা ১১ সেপ্টেম্বর আক্রান্ত হয়েছিলাম৷ তাই চূড়ান্ত বিবেচনায়, এটা আত্মরক্ষা৷''
জার্মান সরকার সম্ভবত জার্মানিতে অবস্থানরত মার্কিন সেনাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে উন্মুক্ত আলোচনায় আগ্রহী নয়৷ স্টু্টগার্টে যখন আফ্রোকমের ঘাঁটি স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন জার্মানির পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কিন সরকারকে - পানোরমায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী - লিখেছিলেন, আফ্রোকমের নতুন ঠিকানা হিসেবে জার্মানির নাম যেন প্রকাশ্যে নেওয়া না হয়, কেননা এর ফলে ‘অপ্রয়োজনীয় বিতর্ক' সৃষ্টি হবে৷