রাজাকারের তালিকার কথা মনে করানো প্রতিবেদন
৮ জানুয়ারি ২০২০রাজাকারের তালিকা প্রকাশ করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের নামও তালিকায় ঢুকিয়ে একরকম নাকে খতই দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়৷ সমালোচনার মুখে তালিকা প্রত্যাহার করা হয়েছিল৷
সেই ঘটনা দূর অতীতে হারিয়ে যাওয়ার আগেই দেখতে হলো ইংরেজি জাতীয় দৈনিক ‘ডেইলি স্টার'-এর একটি বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন৷ প্রতিবেদনের বিষয় শিশু নির্যাতন৷ জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে ২০১৯ সালে দেশে হয়ে যাওয়া শিশু নির্যাতন নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'৷ ডেইলি স্টারের অনলাইন ইংরেজি সংস্করণে সেই খবরের শিরোনাম, ‘‘গত বছর সহিংসতায় প্রাণ গেছে ৯৮৬ শিশুর''৷
‘ধর্ষণ, হত্যা, নির্যাতন, সড়ক দুর্ঘটনা এবং অন্যান্য' সহিংসতায় নিহতদের এ হিসেবে নেয়া হয়েছে জানিয়ে তারপরই বলা হয়েছে তাদের মধ্যে (অর্থাৎ ৯৮৬ জনের মধ্যে) ৫৫৩ জন মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়, ২৫২ জন পানিতে ডুবে এবং ৩৬১ জনকে হয় খুন নয়তো ধর্ষণের শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে৷
যোগফল কিন্তু ৯৮৬ হয় না, যোগফল দাঁড়ায় ১১৬৬!
প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, আটটি জাতীয় দৈনিকের তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন৷ তাই খুব প্রাসঙ্গিক তিনটি প্রশ্ন:
এক. কোন আটটি দৈনিকের তথ্য?
দুই. এমন বিভ্রান্তিমূলক তথ্য কি তাদের?
তিন. নাকি মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের?
এই তিনটি প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে আরো কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের অনলাইন সংস্করণ দেখা হয়েছে৷ কিন্তু তাতে বিভ্রান্তি এবং সন্দেহ আরো বেড়েছে৷
সারাবাংলা ডটনেট-এর শিরোনাম ‘‘সড়কে,পানিতে ডুবে ও নির্যাতনে ১ বছরে ৯৮৬ শিশুর মৃত্যু''৷
৯৮৬ জনের হিসাব ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তারা লিখেছে, ‘‘২০১৯ সালে বিভিন্ন দুর্ঘটনা ও নির্যাতনে দেশে ৯৮৬ শিশুর মৃত্যু হয়েছে৷ এর মধ্যে সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা ৫৫৩ ও পানিতে ডুবে মারা গেছে ২৫২ জন শিশু৷ এছাড়া ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে আরও ৩শ ৬১ শিশু৷ '' এখানেও যোগফল কিন্তু ১১৬৬-ই৷ ‘‘ধর্ষণচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে আরও ৩শ ৬১ শিশু'' লিখে শিরোনামের ৯৮৬-কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে তারাও৷
তাদের ব্যাখ্যায় সড়ক দুর্ঘটনা আর ডুবে মরাকে নির্যাতন হিসেবে গণ্য করা হয়নি৷ তাহলে ডেইলি স্টারের শিরোনাম কি পুরোপুরি ভুল?
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদনকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে গিয়ে আরেক প্রতিবেদনে গত বছর শিশু ধর্ষণ কী হারে বেড়েছে তা আলাদা করে জানিয়েছে সারাবাংলা ডটনেট৷ সেই খবরের শিরোনাম, ‘‘একবছরে শিশু ধর্ষণ বেড়ে আড়াই গুণ''৷
অথচ একই খবরে বাংলা ট্রিবিউনের শিরোনাম, ‘‘২০১৯ সালে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে তিন গুণ''৷ আবার সারাবাংলা ডট নেট যেখানে বলছে, ‘‘এছাড়া ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে আরও ৩শ ৬১ শিশু''; বাংলাট্রিবিউনের তাদের প্রতিবেদনে একই বিষয়ে বলেছে, ‘‘২০১৯ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯০২ জন শিশু৷''
কোথায় ৩৬১ আর কোথায় ৯০২!
কত বড় ফারাক, পাঠক একটু খেয়াল করুন৷
চ্যানেল আই-এর অনলাইন সংস্করণ বাংলাট্রিবিউনের সঙ্গে মিল রেখেই শিরোনাম করেছে, ‘‘২০১৯ সালে সারাদেশে ধর্ষণের শিকার ৯০২ জন শিশু৷''
কিন্তু তারপরই লিখেছে, ‘‘৯৩ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ এছাড়া ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা, হত্যা, অপহরণ, নিখোঁজ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে আরো ৩৬১ জন৷''
এই দুটোর যোগফল কিন্তু ৪৫৪৷ ৯০২ মোটেই নয়৷
কালের কণ্ঠেরও শিরোনাম, ‘‘২০১৯ সালে ৯০২ শিশু-তরুণী ধর্ষণের শিকার : এমজেএফ৷''
কিন্তু শিরোনামের পরই দেয়া হয়েছে ভয়াবহ তথ্য৷ লিখেছে, ‘‘২০১৯ সালে বাংলাদেশে ৯০২ শিশু ও তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছে৷ ''
এখানে শিশুর সঙ্গে তরুণীও ঢুকে পড়েছে৷ ভাবা যায়!
এই সংবাদভাষ্য লেখার সময় দেশের অন্য কোনো সংবাদমাধ্যমে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'-এর কাজটি নিয়ে কোনো প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়নি৷
তাই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনগুলোর বিভ্রান্তি সাংবাদিকদের ভুল কিনা বুঝতে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন'-এর হোমপেজে ঢুঁ মেরেছি৷ আশা ছিল, দায়িত্বশীলতা এবং পেশাদারিত্বের প্রমাণস্বরূপ সেখানে একটা প্রেসরিলিজ অন্তত থাকবে৷
দুর্ভাগ্যের বিষয়, সেখানে তা নেই৷
তাহলে এমন বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন প্রকাশের দায় মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনও কি এড়াতে পারে?
শিশু নির্যাতন নিয়ে এমন বিভ্রান্তিকর প্রতিবেদন কি কোনো সংবাদমাধ্যম বা মানবাধিকার সংস্থা করতে পারে? করা উচিত?
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন বলেছে, ‘‘ ২০১৮ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে শিশুদের নিয়ে ইতিবাচক সংবাদের পরিমাণ কমেছে আশঙ্কাজনক হারে৷''
শিশু নির্যাতন নিয়ে এত বিভ্রান্তিকর তথ্যও কিন্তু একটি নেতিবাচক সংবাদ৷