1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

লাগাতার নাটক করলে কি আর বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে

গৌতম হোড় নতুন দিল্লি
১৯ মার্চ ২০২১

এখন নাকি রাজনীতি করতে গেলে ক্যামেরার সামনে একটু আধটু নাটক করতে হয়৷ সেটা করতে গিয়ে বিশ্বাসোগ্যতাই শেষ হয়ে যাচ্ছে৷

https://p.dw.com/p/3qrOE
প্রতীকী ছবিছবি: DW/R. Oberhammer

কথাটা বলেছিলেন শাহরুখ খান৷ ‘‘যেদিন বাড়ির বারান্দায় এসে দেখবো সামনে ভক্তদের ভিড় নেই, সেদিন থেকে আতঙ্কে ঘুম হবে না৷’’ এই আশঙ্কাটা শুধু নায়ক-নায়িকাদের থাকে, তা নয়৷ রাজনীতিবিদ, খেলোয়াড় থেকে শুরু করে অনেকেরই মনে হয়, মানুষ যদি চিনতে না পারে, পাশে ভিড় না করে, বাহবা না দেয়, তা হলে তো সর্বনাশ৷ সেক্ষেত্রে উপায়?

উপায় একটাই- টিভিতে নিয়মিত মুখ দেখিয়ে যাও৷ মানুষ মুখ দেখতে থাকলেই বুঝবে, রাজনীতিকের গুরুত্ব আছে৷ ভারতে আবার নিজের রাজ্যের বাইরেও পরিচিত হতে চান রাজনীতিকরা৷ বিশেষ করে মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়ক, দলের কর্মকর্তারা৷ সর্বভারতীয় ইমেজ দরকার যে৷ তা এটা করতে গেলে টিভি-র ক্যামেরাম্যান বা সাংবাদিকরা যদি একটু আধটু অভিনয় করতে বলে, তাতে অসুবিধা কোথায়?

তা সেরকম দৃশ্যও তো কম দেখলাম না৷ পশ্চিমবঙ্গের এক রাজনীতিকের কথাই ধরুন৷ বছর দশেক আগে তার হিট প্রতিক্রিয়া ছিল, সরাতে গেলাম হার্মাদ, নিয়ে এলাম উন্মাদ৷ তিনি একটি চ্যানেলে ওই কথা বলে দিয়েছেন৷ সেটা দেখে অন্য চ্যানেলের মাথায় হাত৷ সঙ্গে সঙ্গে নির্দেশ৷ ওই বাইটই চাই৷ তখন সাংবাদিক ছুটলেন নেতার কাছে৷ শুরু হলো বাইট নেয়া৷ কিন্তু নেতা আর ওই লাইন বলছেন না৷ নানাভাবে ঘুরিয়েফিরিয়ে প্রশ্ন করেও লাভ হলো না৷ তখন সাংবাদিক রেকর্ডিং বন্ধ করে বললেন, ওই হার্মাদ-উন্মাদটা বলতে হবে৷ রাজনীতিক বললেন, আরে আগে বলবে তো, ওটাই চাই৷ আবার রেকর্ডিং শুরু৷ এবার তিনি বলে দিলেন সেই কথাটা৷ চ্যানেল কর্তা, প্রোডিউসার, সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন৷

ওই বাইট না পেলে 'কেস’ খেতেন সাংবাদিক৷ তাই নিজের চাকরি বাঁচাতে এবং বসদের গালাগালির হাত থেকে বাঁচতে টিভির সাংবাদিকরা হামেশাই রাজনীতিক এবং অন্য সেলিব্রিটিদের একটু-আধটু ডামি পোজ দিতে বলেন, একটু পছন্দের কথা বলার অনুরোধ করেন৷ তারাও সানন্দে তা মেনে নেন৷

বছর কয়েক আগের কথা৷ অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী তখন চন্দ্রবাবু নাইডু৷ তিনি বিজেপি-র সঙ্গে ছিলেন৷ কিন্তু অন্ধ্রের জন্য বিশেষ প্যাকেজ দাবি করছেন৷ তার দলের সাংসদরা প্রতিদিন সংসদে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন৷ একজন তারকা সাংসদ প্রতিদিন নানারকম সেজে আসতে শুরু করলেন৷ তিনি কখনো অর্ধনারীশ্বর, কখনো কোনো দেবতা, কখনো অন্য কোনো জনপ্রিয় চেহারা৷ তখন প্রথমে তেলুগু দেশম সাংসদরা বিক্ষোভ দেখাতেন সংসদের গান্ধীমূর্তির সামনে৷ তারপর লোকসভায়৷ তা গান্ধী মূর্তির সামনে প্রতিদিন আলোকচিত্রী ও টিভির ক্যামেরাম্যানদের আকর্ষণের কেন্দ্রে থাকতেন তিনি৷ তাকে ক্যামেরার জন্য বারবার অভিনয় করে দেখাতে হতো৷ যাবতীয় অনুরোধ তিনি হাসিমুখে মেনে নিতেন৷ কখনো হাতে ছোট বাজনাও থাকতো, সেটাও বাজাতেন৷ তারপর শুরু হতো লোকসভা-পর্ব৷

এরকম তো কত ঘটনাই ঘটেছে৷ এক ক্রীড়াবিদ সাংসদ কোনো বিশেষ উপলক্ষে সংসদ ভবন চত্বরে পায়ে বল নাচালেন৷ ব্যাস, টিভি ক্যামেরা ভিড় করে এলো৷ তাকে বল নাচিয়ে যেতে হলো৷ থামালেই বলা হচ্ছে, নাচাতে হবে৷ তিনিও নাচাচ্ছেন৷ আবার দুই তারকা সাংসদ জিতে আসার পরে প্রথমদিন যখন সংসদ ভবনে এলেন, তখন প্রায় ফটো শুটের মতো পোজ দিয়ে গেলেন অনুরোধে৷

তা এসব হয়৷ হয়ে থাকে৷ যবে থেকে টিভি জনপ্রিয় হয়েছে, প্রতিযোগিতা চরমে উঠেছে, সামাজিক মাধ্যম এসে গেছে, তবে থেকে এসব হচ্ছে বইকি৷ এর মধ্যে অনেকগুলি নির্দোষ হতে পারে৷ কোনো ঘটনা হলো, তার ডামি পোজ দিলে তাতে গেল গেল রব তোলার দরকার হতো না৷ কিন্তু বাস্তবতা হলো, নিশ্চয়তা তো নেই৷ কোনো ঘটনা না ঘটলেও যে অভিনয় করে তা তৈরি করা হতে পারে৷ কোনো সিচুয়েশন ক্যামেরার সামনে তৈরিও হতে পারে৷ ফেক নিউজের রমরমার যুগে গ্যারান্টি কে দেবে৷ আর গ্যারান্টি দিলে বিশ্বাসই বা করবে কে? সন্দেহ করাই তো এখন দস্তুর৷

গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লি
গৌতম হোড়, ডয়চে ভেলে, নতুন দিল্লিছবি: privat

ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের মতো রাজনীতিক তো বেশি নেই৷ গল্পটা আমার এক অতি বিশ্বাসযোগ্য ব্যক্তির কাছ থেকে শোনা৷ মনমোহন তখন অর্থমন্ত্রী৷ যোজনা কমিশনের বৈঠকে এসেছেন৷ তার দীর্ঘদিনের পরিচিত, সহকর্মীও এসেছেন সেই বৈঠকে৷ তিনি মনমোহনকে বললেন, তার গাড়ি বিগড়েছে৷ তাই বৈঠক শেষে ফেরার সময় যদি তাকে অফিসে ড্রপ করে দেন, তাহলে তার সুবিধা হয়৷ মনমোহনের সঙ্গে তিনি ফিরছেন৷ মনমোহন ওই সহকর্মীর অফিসের কিছুটা আগে গাড়ি থামাতে বললেন৷ ওই সহকর্মীকে বললেন, এটা সরকারি গাড়ি বলে তিনি সহকর্মীকে তার অফিসে ছাড়তে পারছেন না৷ তিনি নিজের অফিসের পথ থেকে বিচ্যূত হবেন না৷ হতভম্ব সহকর্মীকে নামিয়ে দিয়ে নিজের পথে অফিসে গেলেন মনমোহন৷ সরকারি গাড়ির কোনো অপব্যবহার করবেন না বলে৷ সেজন্যই তো তার বিরুদ্ধে বিরোধীরা অনেক অভিযোগ করেছিলেন৷ কিন্তু কোনোটাই মানুষ বিশ্বাস করেনি৷ এরকম মানুষ যে বেশি নেই৷ না হলে রাজনীতির ক্ষেত্রে বিশ্বাসের এরকম ঘাটতি হতো না৷

তাই রাজনীতিকরা হয়ত সত্যি সত্যি কিছু করছেন, কিন্তু মানুষের মনে হয়, তারা নাটক করছেন৷ সেই বাঘ আর রাখালের গল্প আর কি৷ রাখাল মাঝে মাঝেই মিছিমিছি বাঘ এসেছে বলে চেঁচাত৷ গ্রামবাসী ছুটে এসে দেখত কিছুই হয়নি৷ যেদিন সত্যি সত্যি বাঘ এল, তখন রাখালের চিৎকার কেউ বিশ্বাস করল না৷ দেখতেও এল না৷ তাই জনপ্রিয়তা বজায় রাখতে গিয়ে, টিভিতে লাগাতার মুখ দেখাতে গিয়ে ছোট ছোট নাটক করার ফল বড় হয়ে দেখা দিতেই পারে৷

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি গৌতম হোড়৷
গৌতম হোড় ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি৷
স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য