পশ্চিমবঙ্গে কেন আক্রান্ত হবেন বিরোধী রাজনীতিকরা
১১ ডিসেম্বর ২০২০ভোট এলেই পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভয়াবহ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক সংঘর্ষ, হত্যা, গুলি, মারধর তখন নিত্যদিনের ঘটনা। পশ্চিমবঙ্গে এর আগে রাজ্য বিজেপি সভাপতি আক্রান্ত হয়েছেন। আক্রান্ত হয়েছেন কংগ্রেস, বিজেপি, বাম নেতা-কর্মীরা। এ বার হলেন বিজেপি-র সর্বভারতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডা। বুধবার কলকাতা থেকে ডায়মন্ড হারবার যাওয়ার পথে তাঁর কনভয়ে ইটবৃষ্টি হয়। অনেকগুলি গাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর নাড্ডা থেকে শুরু করে বিজেপি নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শাসনে আইন ও শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে বলে অভিযোগ করেন। রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি আগেই উঠেছিল। তবে নাড্ডা তা খারিজ করে বলেছেন, রাজনৈতিকভাবে তৃণমূলের মোকাবিলা করা হবে। আর রাজ্যপালের হুঁশায়ারি, মমতা যেন আগুন নিয়ে না খেলেন।
বিজেপি-র কাছ থেকে এই ধরনের প্রতিক্রিয়া প্রত্যাশিত। লাগাতার আক্রান্ত হলে এই ধরনের কথাই বলা হয়। বাম আমলে তৃণমূল বা কংগ্রেসের নেতারাও বলতেন। কিছু বিশেষজ্ঞের মতে, যেটা অপ্রত্যাশিত, তা হলো তৃণমূলের প্রতিক্রিয়া এবং সেখানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর ভাইপো সাংসদ অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় দুই ধরনের কথা। মুখ্যমন্ত্রীর দাবি, বিজেপি কর্মীরাই নাড্ডার কনভয়ে ইট ছুড়েছে। তিনি বলেছেন, ''চাড্ডা, নড্ডা, গড্ডা, ফড্ডা, ভাড্ডা। তোমার পিছনে ৫০টি গাড়ির কনভয়। তা হলে কি প্ল্যান ছিল?'' অভিষেক বলছেন, ''বিজেপি-র জে পি নাড্ডা ডায়মন্ড হারবারে যেতে গিয়ে গাড্ডায় পড়েছেন। সাধারণ মানুষের ক্ষোভের মুখে পড়লে তার দায়িত্ব তো আমার নয়।'' ডায়মন্ড হারবার হলো অভিষেকের কেন্দ্র। মমতা বলছেন বিজেপি কর্মীরা ইট ছুড়েছে, আর এলাকার সাংসদ বলছেন, ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ ইট ছুড়েছে। তা হলে কোনটা সত্যি?
পশ্চিমবঙ্গে সমানে এই ধরনের রাজনৈতিক সংঘর্ষ দেখে বিচলিত প্রবীণ সাংবাদিক শুভাশিস মৈত্র ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ''পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে দীর্ঘদিন ধরে সহিংসতা হচ্ছে। এটা এ বার বন্ধ হওয়া দরকার। সব চেয়ে খারাপ ব্যাপার হলো, এই ঘটনাগুলোকে জাস্টিফাই করার চেষ্টা চলছে। বাঙালি হিসাবে আমার খারাপ লাগছে। রাজনীতিতে তো একটা শালীনতা থাকতে হবে।''
এই ঘটনার পর বৃহস্পতিবার কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক রাজ্যের মুখ্যসচিব ও পুলিশ প্রধানকে দিল্লিতে ডেকে পাঠিয়েছে। আগামী ১৪ ডিসেম্বর তাঁদের স্বরাষ্ট্র সচিবের সঙ্গে দেখা করতে বলা হয়েছে। অমিত শাহ বলেছেন, এই ঘটনা বর্বরোচিত। মমতার দাবি, কেন্দ্রীয় নেতা, মন্ত্রীরা রাজ্যে আসেন। কিন্তু রাজ্য সরকারকে কিছুই জানান না। তাঁদের জন্য কেন্দ্রীয় নিরাপত্তার ব্যবস্থা থাকে। কিন্তু নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সাবেক পুলিশ কর্তা ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, কেন্দ্রীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও মন্ত্রীদের সফরের বিস্তারিত তথ্য কেন্দ্র বা দল না দিলেও পুলিশ তার খবর রাখে। গোয়েন্দারা সে ব্যাপারে রিপোর্ট পাঠান। রাজ্যে আইন-শৃঙ্খলার সঙ্গে যুক্ত কোনো ঘটনা ঘটলে সরকার দায় এড়াতে পারে না। যদি বিজেপি কর্মীরা এই কাজ করে থাকে, তা হলে পুলিশ তাদের ধরল না কেন?
বিজেপি-র অভিযোগ, এই আক্রমণের আসল উদ্দেশ্য হলো, কর্মীদের ভয় দেখানো। যাতে তাঁরা ভোটের কাজ না করেন। বিজেপি-র রাজ্য নেতা সৌরভ শিকদার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন,'' তৃণমূল চাইছে বিজেপি কর্মীরা যেন ভয় পেয়ে বসে যায়। কিন্তু ফল উল্টো হচ্ছে। কারণ, বিজেপি কর্মীরা জেনে গেছেন, আগামী বিধানসভা নির্বাচনে আমরাই জিতব। তাই তাঁরা জমি আঁকড়ে পড়ে থাকছেন।''
উল্টো মত যে নেই তা নয়। প্রবীণ সাংবাদিক সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায় অবশ্য ডয়চে ভেলেকে বলেছেন, ''কোনো সন্দেহ নেই, এই ধরনের আক্রমণ নিন্দনীয় এবং কখনোই হওয়া উচিত নয়। কিন্তু বিজেপি যে গেল গেল রব তুলেছে, তাও মেনে নেয়া যাচ্ছে না। বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে যা হচ্ছে, তা তারা ধামাচাপা দিয়ে রাখে। আর কিছু ঘটনা নিয়ে হইচই করে।'' সৌম্যের মতে, ''কাশ্মীরে কী হচ্ছে, তার বেশিরভাগটাই জানতে দেয়া হয় না। সমানাধিকারের তোয়াক্কা না করে বিজেপি শাসিত রাজ্য লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে আইন করে। গোরক্ষার নামে লোককে পিটিয়ে মারা হয়। দেশদ্রোহিতার নামে পেটানো হয়। সরকারের কোনো হেলদোল নেই। নাড্ডার কনভেয় আক্রমণ নিন্দনীয়। কিন্তু অন্য ক্ষেত্রে বিজেপি কেন চুপ থাকে?''
কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, মমতা অন্য একটা বার্তাও দিতে চাইছেন। সেটা হলো, তিনিই একমাত্র বিজেপি-র মোকাবিলা করতে পারেন। অন্য কেউ নয়। সংবাদিক জয়ন্ত ভট্টাচার্যের মতে, ''নাড্ডার সঙ্গে যতই কেন্দ্রীয় বাহিনী থাক, স্থানীয় আইনশৃঙ্খলা তো রাজ্যকে দেখতে হবে। ছবি ও ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, তৃণমূলের পতাকা নিয়ে লোকে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে থানার একটা দায়িত্ব থাকবে না?'' ডয়চে ভেলকে তিনি বলেছেন, ''২০১৮ সালের কেন্দ্রীয় ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরোর তথ্য বলছে, দেশের মধ্যে সব চেয়ে বেশি রাজনৈতিক খুন পশ্চিমবঙ্গে হয়েছে। ১২টা। সারা দেশে এই সংখ্যা হলো ৫৪। ফলে রাজনৈতিক সংঘর্ষের প্রবণতা পশ্চিমবঙ্গে বেশি।''