ইতিহাস গড়া নারী ফুটবল কোচ মিরোনার সাক্ষাৎকার
৩ মার্চ ২০১৯ভারতের একটি রাজ্য দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাব পেয়েছিলেন মিরোনা৷ কিন্তু প্রশিক্ষক হতে বিপিএড পরীক্ষা থাকায় সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তিনি৷ তবে ভালোই হয়েছে৷ কারণ সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে দেশেই পেয়ে যান বিরাট সুযোগ, নাম লেখান ইতিহাসে৷ বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটি পুরুষ ফুটবল দলের নারী কোচ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন ২৬ বছর বয়সি বাগেরহাটের মেয়ে মিরোনা৷
তাঁর কাছে পুরুষ দলের কোচ হওয়ার প্রস্তাবটা আসে অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবে৷ এবারই প্রথম ‘বাংলাদেশ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ'এ নতুন দল গড়েছে ‘ঢাকা সিটি এফসি'৷ মিরোনা এই দলেরই কোচ৷ দলটি গড়তে সহযোগিতা করেছে নৌবাহিনী৷ মিরোনা বর্তমানে সেখানকার অ্যাথলেট৷
২০১৬ সালে জাতীয় ফুটবল দল ছেড়ে দেয়ার পর পেশাদার কোচের এএফসি ‘বি' লাইসেন্স কোর্সটা সেরে ফেলেন মিরোনা৷ যদিও কাজটা অত সহজ ছিল না৷ ২৬ জন কোর্স করেছেন, পাস করেছেন মাত্র ৮ জন৷ কোর্সটা দেশে করলেও সার্টিফিকেটটা এসেছে মালয়েশিয়া থেকে৷ আর কোচিং করিয়েছেন ও পরীক্ষা নিয়েছেন জার্মান নাগরিক পলমলি৷ তাঁকে সন্তুষ্ট করেই নিতে হয়েছে সার্টিফিকেট৷ ২০০৯ সাল থেকে নারী ফুটবলার হিসেবে খেলেছেন জাতীয় দলে৷ মিডফিল্ডার ছিলেন তিনি৷
ঢাকা সিটি এফসির প্রধান কোচ আবু নোমান নান্নু৷ কিন্তু তিনি ‘সি' লাইসেন্সধারী৷ অথচ চ্যাম্পিয়নশিপ লিগের নতুন নিয়মে প্রধান কোচের অবশ্যই ‘বি' লাইসেন্স থাকতে হবে৷ তাই প্রধান কোচ হিসেবে কাগজে কলমে দেখানো হয়েছে মিরোনাকে৷ পেশাদার লীগে দীর্ঘদিন কোচের দায়িত্ব পালন করা নান্নুর সঙ্গে কোনো বিবাদ নেই মিরোনার৷ দু'জনে মিলেই সামলাচ্ছেন দল, পরামর্শ করেই ভালো করার চেষ্টা করছেন তাঁরা৷
অনুভূতি
ডয়চে ভেলের সঙ্গে আলাপকালে মিরোনা বলেন, ‘‘এটা আমার জীবনে একটা বড় পাওয়া৷ লাইসেন্স পাওয়ার পর কোচ হিসেবে এটাই আমার প্রথম ক্লাব৷ অফার পেয়েই লুফে নিয়েছি৷ ভীষণ ভালো লাগছে৷ নৌবাহিনীর সাবেক প্রধান ভাইস এডমিরাল নিজাম উদ্দিন আহমেদ নিজেও ফুটবল প্লেয়ার ছিলেন৷ তিনি চান বাংলাদেশে বার্সেলোনার মতো একটা ক্লাব হবে, যেখানে ফুটবলার তৈরি হবে শিশুকাল থেকেই৷ আমাদের দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা, যখন ছেলেরা ফুটবলার হতে আসে তখন দেখা যায় তার বয়স বেড়ে গেছে, পেশিগুলো শক্ত হয়ে গেছে৷ ফলে সে চাইলেও নিজেকে ভালো ফুটবলার হিসেবে তৈরি করতে পারে না৷''
চ্যালেঞ্জ
একজন মেয়ে হয়ে পুরুষ ফুটবলারদেরঅনুশীলন করানোর চ্যালেঞ্জটা বেশ ভালোভাবেই নিয়েছেন মিরোনা৷ বলছিলেন, ‘‘আসলে যখন কোচ হিসেবে কোনো ফুটবলারের সামনে দাঁড়াই তখন সে ছেলে না মেয়ে সেটা মাথায় রাখি না৷ ওদের শেখানোটাই বড় বিষয়৷ কীভাবে ওদের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারছি, সেটা নির্ভর করে আমার নিজের দক্ষতার উপর৷ ওদের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এখনো কোনো বাধার মুখে পড়িনি৷ আমি কোচের কাজটা দারুণভাবে উপভোগ করছি৷ আসল কথা আমি কী দিতে পারছি, আর ছেলেরা কতটুকু নিচ্ছে৷''
মাস দু'য়েক আগে গত ২৪ ডিসেম্বর প্রধান কোচের দায়িত্ব নেওয়ার পর গেল ফেব্রুয়ারিতেই ছিল প্রথম ম্যাচ৷ ফরাশগঞ্জের কাছে ১-০ গোলে হেরে গেছে তাঁর দল ঢাকা সিটি এফসি৷ কিন্তু দলটির তরুণদের মেধা মুগ্ধ করেছে মিরোনাকে৷ বলছিলেন, ‘‘অনেক দূরের স্বপ্ন নিয়েই এই দলের দায়িত্ব নিয়েছি৷ এই দলটাকেই বিপিএলে (প্রিমিয়ার লিগ) দেখতে চাই৷ এই দলে যে তরুণরা আছে তাদের শেখার আগ্রহটাই বেশি মুগ্ধ করেছে আমাকে৷ ওরা অনেক ভালো মানের ফুটবলার৷ ওদের যেমন মেধা আছে, আছে সম্ভাবনাও৷''
নিয়মিত মাঠে অনুশীলন করাচ্ছেন উল্লেখ করে মিরোনা বলেন, ‘‘ইতিহাসের অংশ হতে পেরে আমি সত্যিই রোমাঞ্চিত৷ আমি জানতাম আগে কোনো নারী পুরুষ দলের কোচিং করায়নি৷ তাই প্রস্তাবটা পাওয়ার পর অন্য কোনো চিন্তাই করিনি৷''
সাত বছর দাপটের সঙ্গে নারী ফুটবল দলের মাঝমাঠের দায়িত্ব পালন করা মিরোনার অ্যাথলেটিক্সেও সরব উপস্থিতি ছিল৷ অ্যাথলেটিক্সে মাঠ মাতিয়েছেন বিজেএমসি ও নৌবাহিনীর হয়ে৷ দূরপাল্লার দৌঁড় ৮০০, ১৫০০ ও ৩০০০ মিটারে জাতীয় প্রতিযোগিতায় সোনা জিতেছেন ১৩টি৷
নারী ফুটবলের প্রসার
মিরোনা বলছিলেন, ‘‘নারী ফুটবলারদের এখানে একটা বড় বাধা, আর্থিক সুবিধা৷ নিয়মিত যদি লিগগুলো হতো তাহলে অনেক প্লেয়ারই উঠে আসত৷ ২০১২ ও ২০১৩ সালে লিগ হয়েছে৷ এরপর আর লিগ হচ্ছে না৷ আমরা যখন লিগ খেলেছি তখন অনেক টাকা পয়সা পেয়েছি৷ এখন লিগ না হওয়ার কারণে প্লেয়াররা কোনো আর্থিক সুবিধা পাচ্ছে না৷ একটা মেয়ে যদি ফুটবল খেলে বাবা মায়ের হাতে কিছু টাকা তুলে দিতে পারত তাহলে অনেক মেয়েই এখানে আসত৷ বাফুফে ৩০টা মেয়েকে ক্যাম্পে রেখে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে৷ কিন্তু দেশের আনাচে কানাচে বহু মেয়ে আছে, যাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে ভালো ফুটবলার বানানো যায়৷ লিগ না থাকায় তারা সে সুযোগগুলো পাচ্ছে না৷''
বাংলাদেশের ফুটবল
বাংলাদেশে কেন আন্তর্জাতিক মানের প্লেয়ার তৈরি হচ্ছে না? জবাবে মিরোনা বলছিলেন, ‘‘আমার টিমে যারা খেলছে, তাদের কাছে আমি জানতে চেয়েছিলাম, তারা আগে কখন খেলেছে? তারা বলেছে, ছোটবেলায় খেলেছে, এরপর ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর আবার খেলায় এসেছে৷ এই যে মাঝে একটা বিরাট গ্যাপ... সেখান থেকে তারা চাইলেও আর পারছে না৷ বিদেশের মতো আমাদের প্লেয়ারদের শিশুকাল থেকেই শুরু করতে হবে৷ তাহলে তারা অনেক কিছুই শিখতে পারবে৷ একজন ভালো ফুটবলার হিসেবে গড়ে উঠতে পারবে৷''
এই দুই মাসের কোচিংয়ে আপনি কি ধরনের সংকটে পড়েছেন? জবাবে মিরোনা বলেন, ‘‘আমি আসলে কোনো সংকটে পড়িনি৷ হ্যাঁ, কিছু কথা-বার্তা তো হয়ই৷ সেগুলো শুনলে তো আর আপনি সামনে এগিয়ে যেতে পারবেন না৷ তবে একটা বিষয়, সবাই আমাকে ভালোভাবেই নিয়েছে৷''