মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গ দানে সংস্কারের বেড়াজাল
২০ সেপ্টেম্বর ২০১৯রাষ্ট্রীয়ভাবে বিষয়টিকে উৎসাহিত করার পদক্ষেপের ক্ষেত্রেও উদাসীনতা প্রকটভাবে লক্ষ্যণীয়৷ অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের ক্ষেত্রে সমন্বিত কোনো ব্যবস্থাপনা গড়ে না ওঠায়, বিষয়টি এখনো ব্যক্তিপর্যায়ে সীমাবদ্ধ৷ কয়েকটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন কাজ করছে নানান সীমাবদ্ধতার মধ্যে৷
মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন আইন, ১৯৯৯ সংশোধন করা হয় ২০১৮ সালে৷ এর ফলে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানও গ্রহণের ক্ষেত্রে আত্মীয়ের পরিধি কিছুটা বেড়েছে৷ আগের আইনে শুধু ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, ভাই-বোন, স্বামী-স্ত্রী এবং রক্ত সম্পর্কিত আপন চাচা, ফুফু, মামা ও খালা- এই ১২ জন শুধু আইনত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারতেন৷ তবে সংশোধিত আইনে আপন নানা, নানি, দাদা, দাদি, নাতি, নাতনি, আপন চাচাতো-মামাতো-ফুপাতো-খালাতো ভাই-বোনকেও এ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে৷ এছাড়া মৃত ব্যক্তির অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের শরীরে সংযোজনের সুযোগ রাখা হয়েছে৷ আইনে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বলতে কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, অন্ত্র, যকৃৎ, অগ্ন্যাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চর্ম, টিস্যুসহ মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গপ্রত্যঙ্গকে বোঝানো হয়েছে৷
তবে আইনে যা-ই থাকুক বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় কেবল কিডনি, চোখ, যকৃতের মতো অল্প কিছু অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযোজন সম্ভব৷ তার মানে হলো, কেউ মরণোত্তর দেহদান করলেও তার মাত্র কয়েকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ অন্যের দেহে সংযোজন করার সুযোগ রয়েছে, বাকি সবই নষ্ট হয় শুধু ব্যবস্থাপনার অভাবে৷ মরণোত্তর দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে সহায়তা করার লক্ষ্য নিয়ে ২০১৪ সাল থেকে কাজ করছে ব্যক্তি উদ্যোগের সংগঠন- ‘মৃত্যুঞ্জয়'৷ এর সমন্বয়ক সাগর লোহানী বলছেন, তাদের সংগঠনের মাধ্যমে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০০ জন মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের অঙ্গীকার করেছেন৷ তিনি বলছেন, বিষয়টিতে জনসচেতনতার অভাবই কেবল প্রকট নয়, মৃত্যুর পর দান করা দেহ কারা, কীভাবে নেবে সেখানেও রয়েছে অনেক জটিলতা৷
অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের আগের আইনটি সংশোধনের পর কিছুটা আধুনিক হলেও এখনো অনেক দুর্বলতা রয়ে গেছে বলে মনে করছেন সাগর লোহানী৷ এর কারণ হিসেবে তিনি বলছেন, কিছু কিছু বিষয় এ আইনে যুক্ত করার প্রস্তাব তারা করেছিলেন, যা শেষপর্যন্ত সংশোধিত আইনে আসেনি৷ উদাহরণ হিসেবে তিনি বলছেন, দেশে প্রতিবছর বহু মানুষ অগ্নিদদ্ধ হন, যাদের চিকিৎসায় চামড়া প্রতিস্থাপন প্রয়োজন৷ একজন জীবিত মানুষ তার দেহের চামড়ার কিছু অংশ দান করতে পারেন, কিন্তু আইনে দাতাদের সুনির্দিষ্ট করে দেয়ার ফলে অন্য কারো এটা দান করার সুযোগ নেই৷
রাজধানী ঢাকায় মরণোত্তর দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানের প্রক্রিয়া কিছুটা সহজ৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ, বাংলাদেশ মেডিকেল কলেজের অ্যানাটমি বিভাগে এফিডেভিটের মাধ্যমে অনেকেই মত্যুর পরে দেহদানের অঙ্গীকার করছেন৷ তবে ঢাকার বাইরে এ প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়ে নিরুৎসাহিত হওয়ার ঘটনাও ঘটে৷ এজন্য মূলত মেডিকেল কলেজের সাধারণ কর্মীদের দায়ী করছেন সাগর লোহানী৷ এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের উদাহরণ দিয়ে তিনি বলছেন, সম্প্রতি সেখানে ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক নাট্যকর্মীর মরদেহ দান করতে কোনো সমস্যা হয়নি৷ তবে বেশ কয়েকজন মুসলিম সেখানে দেহদানের অঙ্গীকার করতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন৷ এর পেছনে ধর্মীয় কারণ ছাড়াও দরিদ্র পরিবারের কাছ থেকে চড়া দামে তাদের স্বজনের মৃতদেহ অ্যানাটমি বিভাগের জন্য কেনার একটি অবৈধ বাণিজ্য জড়িত বলেও মনে করছেন তিনি৷
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যানাটমি বিভাগ ২০০৩ সালে প্রথম দান করা একটি মরদেহ পায়৷ এখন পর্যন্ত এই বিভাগের শিক্ষার্থীরা সব মিলিয়ে ১২ জনের দান করা দেহ গবেষণার জন্য পেয়েছেন৷ আর সেখানে ভবিষ্যতের জন্য মরণোত্তর দেহদানের অঙ্গীকার করেছেন ১৮ জন৷ তাদেরই একজন এটিএন নিউজের জ্যেষ্ঠ সংবাদ উপস্থাপক আঁখি ভদ্র৷ আঁখি বলছিলেন, মৃত্যুর পরে চিকিৎসা গবেষণায় যাতে কাজে লাগে সেই উদ্দেশ্যেই তার এমন সিদ্ধান্ত৷ গত ভ্যালেন্টাইন ডে-তে তার মরণোত্তর দেহদানের ঘটনায় পরিচিত অনেকেই উৎসাহিত হয়েছেন৷
আঁখি ভদ্র একই দিনে সন্ধানীতে মরণোত্তর চক্ষুদানও করেন৷ সন্ধানী জাতীয় চক্ষুদান সমিতির কেন্দ্রীয় কমিটি ও সন্ধানী আন্তর্জাতিক চক্ষু ব্যাংক, বাংলাদেশ-এর মহাসচিব ডা. মো. জয়নাল আবদিন জানালেন, ১৯৮৪ সাল থেকে এখন পর্যন্ত তারা সাড়ে ৩ হাজার কর্নিয়া প্রতিস্থাপন করেছেন, যার মধ্যে দাতার কাছ থেকে পাওয়া কর্নিয়া মাত্র ১৬০ থেকে ১৭০টি৷ মরণোত্তর চক্ষুদানের ক্ষেত্রে দীর্ঘদিন বেওয়ারিশ মৃতদেহের ওপর নির্ভরশীল ছিল সন্ধানী৷ তবে পরিবর্তিত আইনে কোনো মৃতদেহ বেওয়ারিশ ঘোষণার জন্য ২৪ ঘণ্টা সময় প্রয়োজন, আর কর্নিয়া সংগহ করতে হয় ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার মধ্যে৷ ফলে বেওয়ারিশ মৃতদেহ থেকে এখন কর্নিয়া সংগ্রহ করা অসম্ভব৷ সে কারণেই মরণোত্তর চক্ষুদান ক্যাম্পেইন জোরদার করার ওপর জোর দিচ্ছেন ডা. আবদিন৷ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে চক্ষুদানে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই দাবি করে তিনি তুলে ধরছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের উদাহরণ, যেখানে ধর্মীয় নেতারাই বিষয়টিকে এগিয়ে নিতে জনসাধারণকে উদ্ধুদ্ধ করছেন৷ ডা. আবদিন বলছেন, অনেক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা ও সংশ্লিষ্ট এলাকার চিকিৎসকের অনীহার কারণে দাতার মৃত্যুর পর কর্নিয়া সংগ্রহ করা যায় না৷ এমনকি দাতার মৃত্যুর অনেকক্ষেত্রে স্বজনের বাধার মুখেও পড়তে হয় সন্ধানী কর্মীদের৷ ফলে একটি সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ও জনসচেতনতা সৃষ্টির তাগিদ দিচ্ছেন তিনি৷
বাংলাদেশে চাহিদার তুলনায় কর্নিয়া প্রতিস্থাপন কতটা দুরাবস্থায় আছে তার একটি হিসাব পাওয়া যায় সন্ধানীর পরিসংখ্যানে৷ ডা. আবদিন বলছেন, দেশে প্রতিবছর ১০ লাখের বেশি মানুষ মারা যায়, তাদের মধ্যে মাত্র ২ শতাংশের কর্নিয়া পাওয়া গেলে সংখ্যাটি হতে পারত ৪০ হাজার৷ অথচ বাস্তবতা হলো- প্রতিবছর সন্ধানী মাত্র ৫০ থেকে ৬০টি কর্নিয়া পাচ্ছে৷ এর বিপরীতে কর্নিয়ার অভাবে অন্ধত্বে ভুগছে ৫ লাখের বেশি মানুষ৷
দেশে সীমিত পরিসরে দেহ ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দান আসলে চাহিদার মহাসমুদ্রে এক ফোটা শিশিরবিন্দু মাত্র৷ একে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে সরকার-হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সমন্বিত ভূমিকা যেমন প্রয়োজন, তেমনি দরকার মানবতার প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের এগিয়ে আসা৷ দরকার জেঁকে বসে থাকা সামাজিক ও মানসিক ট্যাব্যু ভাঙা৷ মানুষ মানুষেরই জন্য- এমন উপলব্ধিই পারে মরোণত্তর দেহ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গ দানে একজন মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে৷
সাংবাদিক সঞ্জয় দের লেখাটি কেমন লাগলো জানান বন্ধুরা, লিখুন নীচের ঘরে৷