মারাদোনাকে ছুঁয়ে দেখা সেই দিনটি
১২ জুন ২০১৮বস্টনের ব্যাবসন কলেজ মাঠ জুড়ে কাটা তারের বেষ্টনি৷ প্রধান গেটের কাছে সশস্ত্র নিরাপত্তা কর্মীরা টহল দিচ্ছে৷ ওদের ফাঁকি দিয়ে ভেতরে যাবার কোনো সুযোগ নেই৷ প্রায় ঘণ্টা কাল দাঁড়িয়ে গাছের ছায়ায়৷ অপেক্ষায় কখন ভেতরে যাবার অনুমতি মেলে৷ আমি একা নই, আমার মতো বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজারো সাংবাদিক আর ফটো সাংবাদিকও সেই অপেক্ষায়৷
হঠাৎ নিরাপত্তা কর্মীদের একজন বলে উঠলেন, ‘‘আর্জেন্টিনা টিম ম্যানেজমেন্ট তোমাদের ভেতরে আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷ তোমরা একটা কিউতে দাঁড়িয়ে যাও৷একজন একজন করে ভিতরে যেতে পারবে৷তবে সবার প্রেস কার্ড থাকতে হবে৷ যাদের প্রেস কার্ড আছে শুধু তারা ভিতরে যেতে পারবে৷''
সব সাংবাদিকের মাঝে একটা অলিখিত প্রতিদ্বন্দিতা৷ লাইনের আগে থাকতে হবে৷ তাহলে আগে ঢোকা যাবে৷ আর প্র্যাকটিসে মারাদোনাকে অন্যদের চেয়ে আগে দেখা যাবে৷ আর প্র্যাকটিসের পর মারাদোনা আর তাঁর দেশ আর্জেন্টিনাকে নিয়ে রিপোর্ট ফাইল করতে হবে৷ সবাই লাইনে দাঁড়িয়ে গেলাম৷ চোখের পলকে অনেক বড়সড় লাইন হয়ে গেল৷ আমি আর কোলকাতার আনন্দ বাজারের রুপক সাহা লাইনের শুরুর ভাগটায়৷ আমরা গেটের কাছে ওয়েট করছি এই সময়টার জন্য৷ নিরাপত্তা বেষ্টনি পার হয়ে পাশাপাশি হাঁটছি৷ ভেতরে এসেই মন জুড়িয়ে গেল৷ পরপর তিন-চারটি মাঠ৷ যেন সবুজ ঘাসের কার্পেট বিছিয়ে রাখা৷ মাঠগুলো উঁচু জায়গায়৷ একটু নীচুতে বাংলো বাড়ির সারি৷ পাশে জিমনেশিয়াম৷ সুইমিংপুল৷ গোটা কলেজ ক্যাম্পাস যেন সুনসান সাজানো গোছানো৷ এতটুকু ময়লা নেই৷ আবর্জনা নেই৷ মাঠের চারপাশ ফিতে দিয়ে ঘেরা৷
মাঠের পাশে দাঁড়িয়েছি, তারকা ফুটবলার ক্যানিজিয়া, গয়কোচিয়া বাতিস্তুতারা অনুশীলন করছেন৷
আগের দিন বস্টনের ফক্সবোরো স্টেডিয়ামে গ্রীসের বিপক্ষে মারাদোনারা যে জার্সি গায়ে খেলেছেন, সেই র্জাসি গায়ে বাতিস্তুতারা অনুশীলন করছেন৷ সবার পেছনে নাম লেখা৷ তা দেখে তারকা ফুটবলারদের চিনতে অসুবিধে হয়নি৷ মাঠে অসংখ্য বল গড়াগড়ি খাচ্ছে৷ চোখ জুড়িয়ে গেল জগৎসেরা ফুটবলারদের দীর্ঘ সময়ের প্র্যাকটিস দেখে৷
কিন্তু, ‘ফুটবল ইশ্বর' মারাদোনা কই ? তাঁকে তো মাঠে দেখছি না৷
তবে কি মারাদোনা আজ প্র্যাকটিস করবেন না?
মারাদোনাকে দেখতে না পেয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল৷
পরের ম্যাচের জন্য নিউইয়র্ক যাওয়া বাদ দিয়ে বস্টন থেকে গেছি মারাদোনাকে কাছ থেকে দেখবো বলে৷ মারাদোনার অনুশীলন দেখবো৷ মারাদোনার অটোগ্রাফ নেবো৷ মারাদোনার সাথে কথা বলবো৷আর বিশ্বকাপে এসেছি মারাদোনাকে দেখবো বলে৷
মারাদোনার খেলা দেখার অভিলাষে৷ তাই ফুটবল ইশ্বরকে না দেখে মনটা বেশ খারাপ৷ এমন সময় আর্জেন্টাইন ক্রীড়া সাংবাদিক সার্জেই লেভনস্কির সাথে দেখা হয়ে গেল৷ বুয়েনস আইরেসের মানুষ আর মারাদোনার কাছের জন সার্জেইয়ের কথা শুনে মনটা ভালো হয়ে গেল৷ সার্জেই বললেন, ‘‘দিয়েগো এখনও আসেনি৷ তবে আসবে৷ তুমি আমার সাথে থেকো৷''
মাঠের একপাশে আর্জেন্টাইন এক টিভি চ্যানেলের কর্মীরা প্রস্তুত৷ ওরা , প্র্যাকটিস মাঠ থেকে দিয়েগোর ইন্টারভিউ সরাসরি প্রচার করবে৷
একটা সময় মাঠের একপাশে ছুটোছুটি লেগে গেল৷আমরা যে জায়গায় দাঁড়িয়ে, তার কাছেই৷ ফটো সাংবাদিকরা ছুটলেন সেদিকে৷
কে একজন জানালো– দিয়েগো আসছেন! ‘ফুটবল ইশ্বর' দিয়েগো, সর্বকালের সেরা ফুটবলার দিয়েগো মারাদোনা আসছেন!
সত্যি সত্যিই দিয়েগো মারাদোনা আসছেন৷ আর্জেন্টাইন জাতীয় দলের বিখ্যাত ‘১০ নম্বর' জার্সি গায়ে৷ শত শত ছবি উঠছে৷ ফটো সাংবাদিকদের ক্যামেরার শাটার চলছে৷ ফ্ল্যাশ জ্বলছে৷ মারাদোনার এক হাতে টেনিস বল, অন্য হাতে লেমনেডের বোতল৷
‘‘ওলে, ওলে'' বলে মারাদোনা আমার সামনে দিয়ে হেঁটে হেঁটে সোজা গিয়ে দাঁড়ালেন টিভি ক্যামেরার সামনে৷ যে সাংবাদিকরা ক্যানিজিয়া, ‘বাতিগোল'দের অনুশীলনের ছবি তুলছিলেন, সবাই ছুটে এলেন,মারাদোনার দিকে৷ পুরো মাঠের সব আকর্ষণ মারাদোনাকে ঘিরে৷ মুহুর্তের মাঝে মারাদোনাকে ঘিরে ভীড়, জটলা তৈরি হয়ে গেল৷ টিভি রিপোর্টার প্রশ্ন করছিলেন,মারাদোনা উত্তর দিচ্ছিলেন৷ প্রায় আধঘন্টা চললো ইন্টারভিউ৷
আমি তন্ময় হয়ে তাকিয়ে৷ মারাদোনার দিকে৷ ফুটবল ইশ্বর , সর্বকালের সেরা ফুটবলার আমার নাগালের মধ্যে! আমার চোখের সামনে!
হঠাৎ টেলিভিশন ইন্টারভিউ শেষ করে সরাসরি প্র্যাকটিসে ভিড়ে গেলেন মারাদোনা৷ মার্কার দিয়ে ছোট গোল পোস্ট বানিয়ে একদিকে ক্যানিজিয়া বাতিস্তুতাকে রেখে, গয়কোচিয়াকে পাশে নিয়ে খেলায় মন দিলেন৷ এক দলে পাঁচ-ছয় জন করে মাঠ ছোট করে ছোট গোল পোস্টে ম্যাচ৷ নিজে গোল করলেন আবার ক্যানিজিয়াদের করা গোল নিয়ে তর্ক জুড়ে দিলেন৷ ছোট ছেলেদের ফুটবল ম্যাচে গোল নিয়ে যেমন বাদানুবাদ হয়, তেমনিন৷ হাসি ঠাট্টায় হালকা মেজাজে গড়িয়ে চললো অনুশীলন৷
দূরে দাঁড়িয়ে তন্ময় হয়ে দেখছি৷ জগৎসেরা ফুটবলারদের অনুশীলন৷ বেশ ক'মিনিট অনুশীলনের পর গয়কোচিয়াকে গোল পোস্টের নীচে রেখে চললো স্পট কিক, কর্নার কিক অনুশীলন৷ পেনাল্টি এবং পেনাল্টি সীমানার বাইরে থেকে ডেড বল বা সেট পিস থেকে মারাদোনা অবলীলায় বল রেখে গেলেন জালে৷ আবার মাঠের দু'পাশ থেকে একের পর এক বল ভাসালেন গোলমুখে৷ গোলের জন্য ভাসিয়ে দেয়া সে বলে নিজেকে শূন্যে ছুড়ে দিয়ে নিপুন হেডে বল জালে রেখে গেলেন বাতিগোল ,ক্যানিজিয়ারা৷
মাথার উপরে সূর্য৷ প্রায় দু' ঘন্টা রোদে পুড়ছি, তা নিয়ে ভাবনা নেই৷ মন জুড়ে শুধুই মারাদোনা আর মারাদোনা৷ হালকা মেজাজের অনুশীলন শেষে মারাদোনা এলেন সাংবাদিকদের সামনে, ঠিক আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে তার পাশে৷ সবাই ডাকছে, ‘‘দিয়েগো , দিয়েগো৷''
‘‘ওলে, ওলে'' বলে এক আর্জেন্টাইন প্রমীলা সাংবাদিককে গলায় জড়িয়ে নিলেন মারাদোনা এবং ওর গায়ে জড়ানো আর্জেন্টাইন টি শার্টে অটোগ্রাফ দিলেন৷ দু'তিন জন সাংবাদিকের সাথে কথা বলে সর্বকালের সেরা ফুটবলার দিয়েগো আরমান্দো মারাদোনা আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ়! হতবাক!
আমার দিকে তাকিয়ে মারাদোনা৷ জগৎ সেরা ফুটবলার আমাকে দেখছেন৷ আমি যেন অন্য জগতে৷ স্বপ্নের জগতে৷ বিলাসী স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছি৷ আমি বাকরুদ্ধ৷ আমার সামনে দাড়িয়ে ফুটবল কিংবদন্তী, যাঁর হাত ধরে আর্জেটিনা ছিয়াশির বিশ্বকাপ জয় করেছে! কোনো একজন ফুটবলারের কাঁধে ভর করে গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ বা বিশ্বকাপ জয়ের নজীর ফুটবল দুনিয়ায় দ্বিতীয়টি নেই৷ তাঁর হাত ধরে রেলিগেশন জোনে থাকা বা তলানির দল নাপোলিও তো ইতালিয়ান লিগ শিরোপা জয় করেছে৷ মারাদোনা যেদিন নাপোলির প্রথম প্র্যাকটিস সেশনে যোগ দিয়েছিলেন, সেদিন নাপোলি স্টেডিয়ামের রাস্তায় ট্রাফিক জ্যাম হয়েছিল৷ হাজার হাজার ফুটবল অনুরাগী ফুটবলের বিস্ময় প্রতিভা মারাদোনাকে স্বাগত জানাতে এসেছিল৷ এসব যখন ভাবছি, তখনই পাশ থেকে সার্জেই বললো ,‘‘ ইসলাম, বলো কিছু৷'' ভাবনায় চ্ছেদ পড়লো৷ আমি কী বলব? আমি তো পুরোপুরি মজে আছি মারাদোনায়৷ আমার হাতে একটা আর্জেন্টাইন সুভেনির, যা প্র্যাকটিসে আসার সময় নিয়ে এসেছি, মারাদোনার অটোগ্রাফ নেবো, এমন ভেবে৷ আর কোনো কিছু না ভেবে আমার হাতে ধরা আর্জেন্টাইন সুভেনির বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, ‘‘অটোগ্রাফ, প্লিজ৷''
আমার হাত থেকে কলম আর সুভেনিরটা নিজের হাতে তুলে নিলেন ফুটবল ইশ্বর৷ অটোগ্রাফ দিচ্ছিলেন মারাদোনা৷ মারাদোনা সুভেনিরের উপর অটোগ্রাফ দিচ্ছেন আর আমি তাঁর হাতের মাংশপেশি দেখছি৷ আর আলতো ছোঁয়া রেখেছি দিয়েগোর হাতে৷
পাশে দাড়ানো নিরাপত্তাকর্মী বলে উঠলো, ‘‘ডোন্ট টাচ!''
সার্জেই বললো, ‘‘এটা তোমার বিষয় নয়৷''
আমি একটু ভরসা পেলাম৷
আমি মারাদোনার হাতে চাপ দিচ্ছি৷ মারাদোনা হাতের পেশি শক্ত করলেন৷ টেনিস বলের মতো হয়ে ফুলে উঠলো মারাদোনার মাংশপেশি৷ যেমন পেশি দেখেছি মিস্টার ওয়ার্ল্ড আরনল্ড শোয়ার্ৎসেনেগার বা সিলভেস্টার স্ট্যালনের, ঠিক তেমন সুগঠিত পেশি মারাদোনার৷
আমি আরো জোরে চেপে ধরলাম৷ দু হাতে চাপ দিলাম৷ কিন্তু এতটুকু দাবাতে পারলাম না, যেন লোহার মতো শক্ত মারাদোনার শরীর৷
মারাদোনা তাকিয়ে আমার দিকে৷ অটোগ্রাফ দেয়ার ফাঁকে আবার জানতে চাইলাম, ‘‘অ্যামেরিকা বিশ্বকাপে শুরুটা দারুন হলো৷ এই দল কতটা পথ পাড়ি দেবে?'' মারাদোনা বললেন, ‘‘আমরা একটা ভালো দল নিয়ে এসেছি৷ আর এই দলটা অনেকটা পথ দৌড়ুাবে৷ প্রথম ম্যাচের পারফরম্যান্স আমাদের প্রেরণা জোগাবে৷ ভালো কিছু করা সম্ভব৷''
আমি তন্ময় হয়ে চেয়ে আছি ফুটবল জাদুকরের দিকে৷ মারাদোনা হেসে চলে গেলেন অন্য এক সাংবাদিকের কাছে৷ তাঁর কাছ থেকে আর একজনের কাছে৷ চারপাশ থেকে সাংবাদিকরা আহবান জানাচ্ছেন, ‘‘দিয়েগো, দিয়েগো৷''
মারাদোনার, ক্লান্তি নেই৷ বিরক্তি নেই৷
আমি নির্বাক৷ মুগ্ধ হয়ে মারাদোনার কথা ভাবছি৷ আর দেখছি মারাদোনাকে৷ আরো বেশ কিছুটা সময় অটোগ্রাফ দিয়ে মারাদোনা ফিরে গেলেন তার বাংলোর দিকে৷
আমি আর রুপক সাহা ফক্সবোরো স্টেডিয়ামের মিডিয়া সেন্টারে যাবার জন্য পা বাড়ালাম৷ পাশ থেকে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করলো, ‘‘তোমরা মিডিয়া সেন্টারে যাচ্ছো? আমি যাচ্ছি৷ তোমাদের লিফট দিতে পারি৷'' আমি ভদ্রতা করে বললাম, ‘‘তোমার কোনো অসুবিধে না হলে যেতে পারি৷'' ঐ সাংবাদিক বললো, ‘‘না না, আমার কোনো প্রবলেম হবে না৷ আমি একা যাচ্ছি৷ তোমাদের সাথে গল্প করে যাওয়া যাবে৷ তোমরা যেতে পারো৷''
আমি আর রুপক আর আপত্তি করিনি৷
ঐ সাংবাদিক একটু পরে জানালো, তার নাম জানুস মাত্তা৷ ব্রাজিলিয়ান৷ রি ও'র স্পোর্টস ডেইলি'র হয়ে কাজ করছে৷ ১৬ জন রিপোর্টার কভার করছে অ্যামেরিকা বিশ্বকাপ৷ মাত্তার দায়িত্ব আর্জেন্টিনাকে ফলো করা৷
মাত্তা ড্রাইভ করছে৷ আমি পাশে৷ পেছনে রুপক৷ গাড়ি এসে পড়ল রাস্তায়৷ মাত্তা আমাদের অবাক করে দিয়ে বললো, ‘‘এবারের বিশ্বকাপের প্রধান আকর্ষণ এই ছোট-খাটো মানুষটা৷ দিয়েগো মারাদোনা৷ অসাধারন এক প্লেয়ার৷ অন্যদের সাথে ওর তুলনা হয় না৷ মারাদোনার হাত ধরে আর্জেন্টিনা আর একবার বিশ্বকাপ জয় করতে পারে৷'' আমরা অবাক হয়ে শুনছি, পেলের দেশের এক সাংবাদিক কী অবলিলায় মারাদোনায় মজেছেন৷ মারাদোনার খেলার প্রশংসা করছেন৷ এটা চিন্তা করা যায় না৷ এটা ভাবাই যায় না৷
ব্রাজিলিয়ান সাংবাদিকের অবাক করার কথা শুনছি আর চোখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে মারাদোনার মুখ৷ আগের দিন গ্রিসের বিরুদ্ধে ফুটবল ইশ্বরের করা গোলটির রিপ্লে যেন ভেসে উঠল চোখের সামনে৷ চোখে ভাসছে মারাদোনার প্র্যাকটিস, ক্যানিজিয়াদের সাথে মারাদোনার দুষ্টুমি, মারাদোনার অটোগ্রাফ নেয়া৷ মারাদোনার সাথে কথা বলার মাহেন্দ্রক্ষণটি৷ ক্রীড়া সাংবাদিকতার জীবনের অন্যতম সেরা এক স্মৃতি৷ স্বপ্নীল এক অনুভূতি৷
মারাদোনাকে কেউ কেউ বিশ্বের সেরা খেলোয়াড় বলেন৷ আপনার কী মত? লিখুন মন্তব্যের ঘরে৷