‘দম্ভ দেখানো সংস্কৃতির অঙ্গে পরিণত হয়েছে’
২৩ এপ্রিল ২০২১ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম মনে করেন, ক্ষমতা বা দম্ভ দেখানো আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গ হয়ে গেছে৷
ডয়চে ভেলে : সম্প্রতি এলিফ্যান্ট রোডের একটি ঘটনায় গাড়িতে স্টিকার এবং গায়ে অ্যাপ্রোন থাকার পরও পুলিশ কেন একজন নারী চিকিৎসকের কাছে পাস চাওয়ায় তুলকালাম ঘটে যায়...
অধ্যাপক সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম : প্রথমত আমি সেখানে ছিলাম না৷ আবার আমাদের দেশের মিডিয়াতে যেভাবে লেখা হয়, সেটা কতটা বিশ্বাসযোগ্য সেটাও বলা মুশকিল৷ আমি একটি ভিডিও ক্লিপ দেখলাম, কিন্তু তার আগে-পিছে কী হয়েছে সেটা তো জানি না৷ তবে যেটুকু মনে হয়েছে, একটা ভুল বোঝাবুঝির ব্যাপার৷ ওই ডাক্তার খুবই আহত হয়েছেন৷ তার ধারণা হয়েছে, কোভিড রোগীদের চিকিৎসার জন্য তারা এত সময় দিচ্ছেন, কিন্তু পুলিশ তাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছে না৷ আবার তার ভাষা ব্যবহার খুব শালীন ছিল সেটাও বলা যাবে না৷ এই ধরনের ভুল বোঝাবুঝি আমাদের দেশে সবখানেই চলে৷ হাসপাতালে যান, সেখানে রোগীর সঙ্গে ডাক্তারের হয়, রেলওয়ে টিকিট কাউন্টারে যান, সেখানে যারা টিকিট বিক্রি করেন তাদের সঙ্গে যাত্রীদের হয়৷ এই বাদানুবাদ আমাদের সমাজের চলমান একটা প্রক্রিয়া৷
আমরা কি এখন হুট করেই একটু বেশি উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি না?
এটি আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই৷ এখন যে পরিবেশ, এটা তার ফল৷ কোভিড যেভাবে হানা দিচ্ছে, মানুষ যেভাবে কাজ হারাচ্ছে, মানুষ যেভাবে শোক ও অপঘাতের শিকার হচ্ছে, পরিবারের ভেতর কেউ যদি হারিয়ে যান, চিকিৎসার সুযোগ না পান, তাহলে ক্ষুব্ধ হওয়া মানুষের পক্ষে স্বাভাবিক৷ এটি শুধু আমাদের দেশে নয়৷ জার্মানির মতো জায়গায় মানুষ রাস্তায় নেমেছে, লন্ডনে রায়ট হয়েছে, অ্যামেরিকাতে বিক্ষোভ হচ্ছে৷ এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা৷ এর পেছনে যে মহামারি চলছে তার বড় ভূমিকা আছে৷ আমাদের সমাজটাই একটা অস্থির সমাজ, সে কারণে আমরা সব সময় উত্তেজিত থাকি৷ আমাদের মনে হচ্ছে, এখানে একটু বেশি হচ্ছে৷ আসলে তা নয়৷ যুক্তিবাদী সমাজেও এটা হচ্ছে৷ প্রিয়জন মারা গেলে মানুষ পাশে দাঁড়াতে পারছে না৷ মস্ত বড় বঞ্চনা তৈরি হয়েছে৷ সেখান থেকেই প্রতিক্রিয়াগুলো হচ্ছে৷ আমি মনে করি, যখন মহামারি চলে যাবে, তখন সুস্থিরতা ফিরে আসবে৷
সাধারণত আমরা যে কোনো ঘটনায় প্রভাব দেখানোর চেষ্টা করি৷ ওই নারী চিকিৎসকের হঠাৎ করেই ক্ষুব্ধ হওয়ার পেছনে কী করোনার চিকিৎসায় চাপ, নাকি তার ক্ষমতা?
উত্তেজিত হলে মানুষ অনেক কিছুই বলে৷ ঠান্ডা মাথায় যারা ক্ষমতা দেখায়, আর যারা উত্তেজনার বশে ক্ষমতা দেখায়, তার মধ্যে আমি একটা বিরাট তফাৎ করতে চাই৷ দেখবেন, পুলিশ যখন কোনো ছাত্রনেতাকে ধরে, তখন ওই ছাত্রনেতা হম্বিতম্বি করে পুলিশের চেয়ে তার ক্ষমতা বেশি সেটি দেখানোর চেষ্টা করে৷ এটির নিষ্পত্তি হতে পারতো, যদি দুই পক্ষই সমাধানের উদ্যোগ নিতেন৷ আমাদের সমাজে পরিবারে, কোথাও গণতন্ত্র নেই৷ আমরা শুধু রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের অভাব খুঁজি, আমাদের সমাজেও তো গণতন্ত্র নেই৷ আমাদের পরিবারেও গণতন্ত্র নেই৷ পিতৃতান্ত্রিক পরিবারে তো কোনো মেয়ে গলা চড়িয়ে কথা বলতে পারে না৷ সেখানে একটি মেয়ে বলছে বলে সবাই তাকাচ্ছেন৷ অথচ পুরুষরা তো প্রতিনিয়ত বাইরে গিয়ে ক্ষমতা প্রদর্শন করছেন, সেটা তো কেউ আগ্রহ নিয়ে দেখছেন না৷ একজন নারী এই ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে সব ক্যামেরা তার দিকে তাক করা, এটি অনাকাঙ্খিত৷
ক্ষমতা দেখাতে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়া কতটা যৌক্তিক?
আপনি যদি ক্ষমতার প্রভাব দেখাতে চান, তাহলে তো আপনি যুক্তি মানছেন না৷ প্রথমত, ক্ষমতাটা দেখানোর কিছু নেই৷ একজন মানুষকে দায়িত্ব দেওয়া হয়, এই দায়িত্বের সঙ্গে তার অনেক রকমের কর্তব্য থেকে যায়৷ যে নিজের কর্তব্য সুচারুভাবে করে, সে তো ক্ষমতা প্রদর্শন করতে পারেন না৷ আর যে ক্ষমতাকে নিচ্ছে নিজের উন্নতির জন্য, পরিবারের উন্নতির জন্য, সে তো ক্ষমতা দেখাবেই৷ দম্ভ দেখানোটা আমাদের সংস্কৃতির একটা অঙ্গ৷ দম্ভ কিন্তু একজন স্কুলের শিক্ষক দেখাবেন না৷ একজন দোকানদার দেখাবেন না৷ দম্ভ দেখাবেন তিনি, যিনি সমাজকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চান৷ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত কারো দম্ভ দেখানোর অবকাশ নেই৷ দম্ভ ক্ষমতার সঙ্গে সম্পর্কিত৷ এটি আমাদের সমাজে যেমন আছে, ভারতেও আছে, পশ্চিমেও আছে৷
অনেক সময় পুলিশের দ্বারাও অনেকে হয়রানির শিকার হচ্ছেন৷ কয়েকদিন আগে স্কয়ার হাসপাতালের একজন চিকিৎসককে রাস্তায় জরিমানা করা হয়েছে৷ কিছু ঘটনায় কী পুলিশ একটু বাড়াবাড়ি করে না?
মাঠ পর্যায়ে যে পুলিশ থাকে, তাদের যেভাবে বলা হয়, তারা সেটাই করে৷ পুলিশের জীবনটা খুবই কঠিন৷ একজন ট্রাফিক পুলিশের কর্মী কিভাবে খাটেন আপনারা দেখেছেন৷ ৮-১০ ঘণ্টা রোদে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়৷ কেউ ক্ষমতা প্রদর্শন করলে তারও রেগে যাওয়াটা স্বাভাবিক৷ আমরা নিজের অধিকারটুকু আদায় করতে চাই, কিন্তু দায়িত্ব পালন করতে চাই না৷ আমার মনে হয়, মাঠ পর্যায়ে যে পুলিশ দায়িত্ব পালন করছেন, তাদের পরিষ্কার কোনো ধারণা দেওয়া হয়নি৷ দেখুন, সর্বাত্মক লকডাউনের নামে একটা জিনিস আমরা আবিস্কার করেছি৷ সর্বাত্মক লকডাউন হলে তো কারফিউর মতো অবস্থা হওয়ার কথা৷ সেটি না করে আমরা মানুষকে চলতে দিচ্ছি৷
নারী চিকিৎসকের ওই ঘটনার পর পাল্টাপাল্টি অবস্থান নিয়েছেন চিকিৎসক ও পুলিশ৷ গুরুত্বপূর্ণ দু'টি পেশার দায়িত্বশীলরা এমন অবস্থান নেওয়ায় কী ধরনের প্রভাব পড়তে পারে?
অবস্থান নেওয়ার কোনো কারণ আমি দেখি না৷ এই যে এক ধরনের দলীয় মনোবৃত্তি, ডাক্তার হলেই ডাক্তারের পাশে দাঁড়ালাম, পুলিশ হলেই পুলিশের পাশে দাঁড়ালাম- এটি আমাদের সমাজে বহুদিন ধরে প্রচলিত, কিন্তু এটা অনাকাঙ্খিত৷ আমি মনে করি এটা তাড়াতাড়ি মিটমাট হয়ে যাওয়া উচিত৷ যখন অনেক চিকিৎসক এই চিকিৎসকের পাশে দাঁড়িয়ে যান, তখন মনে হয় উনি কোনো অপরাধ করেননি৷ সামান্য যদি উনি করেও থাকেন, তখন তার মনে হবে আমি করিনি৷ আবার পুলিশের ক্ষেত্রেও সবাই যখন তার পাশে দাঁড়িয়ে যান, তখন তারও মনে হয় আমি কিছু করিনি৷ আমি মনে করি, যারা দূরে থাকেন, তাদের উত্তেজিত হওয়ার কোনো কারণ নেই৷ আমি মনে করি, ডাক্তার বা পুলিশদের যে সংগঠন আছে, তাদের ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে৷ এটি বেশিদূর গড়াতে দেওয়া উচিত নয়৷ আমি এটা দেখে মোটেও স্বস্তিবোধ করিনি৷
সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিজেকে ক্ষমতাশালী মনে করার যে মানসিকতা, সেটাতে কীভাবে পরিবর্তন আসতে পারে?
পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন আমরা জবাবদিহিমূলক প্রশাসন চালু করতে পারবো৷ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের উপনিবেশিক আমল থেকেই তালিম দেওয়া হয় তারা সর্বেসর্বা৷ উপজেলা বা জেলায় গেলে তিনি সর্বেসর্বা৷ তিনি তো প্রশাসক না৷ তাকে আমরা বলতে পারি সমন্বয়ক৷ আমরা যদি এমন একটা প্রশাসন চালু করতে পারতাম তিনি সবার কাজগুলো দেখবেন, কোথায় সমস্যা আছে, সেটা দেখবেন, সবাইকে নিয়ে বসবেন৷ কিন্তু আমাদের প্রশাসন চলছে বৃটিশ আমলের মডেলে৷ পুলিশ চলছে ১৮৬১ সালের বৃটিশ আইনে৷ প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার জন্য প্রশাসনে যারা আছেন, তারা এমনটা ভাবতে পারেন৷ ঢালাওভাবে এটা বলা ঠিক নয়৷ অনেকেই ভালো কাজ করছেন৷ ১০ জনের মধ্যে ৩ জন খারাপ করলে তারা কিন্তু সবার প্রতিনিধিত্ব করেন না৷ প্রশাসনকে মানুষের কাছে জবাবদিহিমূলক করতে হবে৷ এর জন্য সংস্কার প্রয়োজন৷ দৃষ্টিভঙ্গির সংস্কার প্রয়োজন৷ জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্ত করতে হবে৷ চর দখলের যারা প্রতিনিধি তারা নন, সত্যিকারের জনবান্ধব জনপ্রতিনিধি যারা আছেন, তাদের নিয়ে যদি প্রশাসনটা তৈরি হতো তাহলে সেখানে সমস্যা থাকতো না৷
ক্ষমতাশালী কারো সঙ্গে পরিচয় আছে বলে নিজেকে ক্ষমতাশালী মনে করার আমাদের যে প্রবণতা, সেটা থেকে পরিত্রাণের পথ কী?
ক্ষমতাকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা৷ ক্ষমতার সঙ্গে সুনির্দিষ্টভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্যের একটা সংযোগ ঘটিয়ে দেওয়া উচিত৷ এর জন্য জবাবদিহিতার প্রয়োজন৷ জবাবদিহিতার জন্য যেমন পার্লামেন্টারি কমিটি আছে৷ তাদের কাছে জবাবদিহি করা যেতে পারে৷ সুশীল সমাজ যারা আছেন, তাদের কাছেও প্রকারান্তরে জবাবদিহি করতে হবে৷ মিডিয়ার কাছে জবাবদিহি করতে হবে৷ এটা করা গেলে ক্ষমতার চর্চাটা দায়িত্ব ও সেবার মধ্যে সীমাবদ্ধ হবে৷